আমি শয়তান

আমার কোনো ভূমিকার প্রয়োজন নেই। তোমাদের প্রভু আমাকে বহুবার তোমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তোমরা তা থেকে শিক্ষা নাওনি। কারণ, আমি জানতাম তোমরা স্বার্থপর। অযোগ্য। তোমরা ও তোমাদের বাবাকে বানানো হয়েছে কাদামাটি থেকে। কিন্তু আমাকে, আমাকে বানানো হয়েছে আগুন থেকে! এরপরও আমাকে বলা হয়েছে তোমাদের সামনে সিজদাহ করতে। [১]

কেন? কেন আমি তোমাদের সিজদাহ করব? আমি অভদ্রের মতো সেই আদেশ প্রত্যাখ্যান করেছি। আদাম থেকে আমি অবশ্যই বহুগুণে সেরা। আমার এই প্রত্যাখ্যানের কারণে তোমাদের প্রভু আমাকে ওয়াদা করেছেন—জাহান্নামের ওয়াদা, চিরকালের জন্য…

এ সবকিছুর জন্য দায়ী তোমরা। তোমাদের বাবাকে আমি যেভাবে ঘৃণা করেছিলাম, হিংসে করেছিলাম সেভাবে আমি তোমাদেরকেও ঘৃণা করি। হিংসা করি। তোমাদের ধ্বংস না-করা পর্যন্ত আমি থামব না। আমি একা কেন যন্ত্রণা ভোগ করব। এর ভাগীদার করব তোমাদেরও। যে অভিশাপ আমাকে দেওয়া হয়েছে, আমি চাই তার ফল ভোগ করো তোমরাও। আমি দেখতে চাই তোমরা জ্বলছ। যন্ত্রণায় চিৎকার করছ। ঠিক আমার মতো।

কীভাবে আমি তোমাদের ধোঁকা দিই সেটা অজানা নয়। তোমাদের প্রভু সেটা জানিয়েছেন। তাঁর বার্তাবাহক সেগুলো ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের সতর্কবাণীর পরও আমি ব্যর্থ হই না। কারণ তোমরা—তোমরা দুর্বল ও অকৃজ্ঞ।

আমি আঘাত হানব তোমাদের অন্তরে। আর দুর্বল জায়গাগুলোতে। আমার চক্রান্ত, ধোঁকা আর ছলনার মাধ্যমে আমি সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেব দুষ্কৃতি। মরার আগ পর্যন্ত যা তোমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাবে না।

তবে একটা ব্যাপারে তোমাদের স্পষ্ট জানিয়ে রাখি। তোমাদের দিয়ে অপরাধ করাতে আমার নিজের কোনো ক্ষমতা নেই। তোমাদের স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির উপর আমার কোনো হাত নেই। আমি শুধু খারাপ কাজ করতে তোমাদের উস্কে দিই। কিন্তু তোমরা নিজেরাই সেই খারাপ কাজে আমার অনুসরণ করো। আর এভাবে ধ্বংস করো নিজেকে।

প্রথমে আমি তোমাদের প্রভুর সাথে অন্য কোনো উপাস্যকে শরিক করার মাধ্যমে অপরাধের দিকে টানি। তোমরা পাপী—তোমাদের মধ্যে এই ধারণাকে আমি শক্ত করে তুলি। যার ফলে তোমরা আল্লাহর কাছে সাহায্য চেতে নিজেকে ছোটো মনে করো। তোমাদের মাঝে আমি এই ধারণা গেঁথে দিই যে, ধার্মিক কোনো ব্যক্তির মাধ্যম ছাড়া তোমরা স্রষ্টার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক গড়তে পারবে না। এভাবে শির্কের মধ্যে রেখে আমি তোমাদের আজীবনের জন্য ছেড়ে দিই।

যদি তা করতে না পারি, তাহলে আমি আমার সবসময়কার সেরা অস্ত্র: বড় অপরাধের টোপ ব্যবহার করি। এই টোপের কার্যকারিতা অসীম। সালাত ছেড়ে দিতে আমি তোমাদের প্ররোচিত করি। ছোটোখাটো কাজে আমি তোমাদের মশগুল করে রাখি। তোমাদের মনে আল-কুর’আন শোনার প্রতি ঘৃণা জন্মাই। আর সংগীত শোনার আকাঙ্ক্ষাকে তীব্র করে তুলি। বিয়ে-বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ককে তোমাদের চোখে রঙিন করে তুলি। লালসা আর মদ খাওয়াকে করে তুলি আকর্ষণীয়। তোমাদের মনে এসব কাজের বাসনাকে সদাউস্কে দিই। অবৈধ সম্পর্কের ব্যাপারে তোমাদের মনে এত টান তৈরি করি যে, তোমরা বেমালুম হয়ে যাও: তোমাদের প্রভু এটা তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ করেছেন। ফিরে আসাটা যদিও তোমাদের নিজেদের হাতে; তারপরও তোমরা জান্নাতের প্রতিশ্রুতি ভুলে বসে জড়িয়ে যাও আমার জালে।

তোমরা কি জানো না কীভাবে আমি বারসিসাকে ধ্বংস করেছিলাম?[২] বানি ইসরাইলদের মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে ধার্মিক; কিন্তু দুর্বল। তাই শেষমেষ আমার সাথে আর পেরে ওঠেনি। আমার পথে ওকে মরতে দেখে আমার যে কী ভালো লেগেছে! ওকে ধ্বংস হতে দেখে আমি যারপরনাই আনন্দিত হয়েছি!

বড় অপরাধে জড়ানোর পাতা ফাঁদে তোমরা যদি না জড়াও, তখন আমি তোমাদের ডাকি ছোট অপরাধের দিকে। কোনোমতে যদি তা থেকেও তোমরা বেঁচে থাকতে পারো, তাহলে আমি তোমাদেরকে অনুমোদিত কাজে ব্যতিব্যস্ত রাখি। জীবিকা উপার্জনের পেছনে তোমাদের এতটাই বুঁদ করে রাখি যে, তোমরা আর ‘ইবাদাত করার শক্তি পাও না। ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়ো। তুচ্ছ আর আলতু-ফালতু এমনসব কাজ ধীরে ধীরে তোমাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করাই, যেগুলো কোনো অপরাধমূলক কাজ নয় ঠিকই; কিন্তু তোমাদের সারা সময়কে তা খেয়ে নেয়।

আমি তোমাদের কাছে মোহনীয় করে তুলব এই দুনিয়ার জীবন আর কামনা-বাসনাকে। সম্পদ, ক্ষমতা, খ্যাতি আর নারী দিয়ে তোমাদের প্রলুব্ধ করব। যুক্তি-কারণকে তোমাদের চোখে ঘোলা করে রাখব। সুযোগ নেব তোমাদের দুর্বলতার। কোনো কিছুর প্রতি একটার পর একটা তীব্র অনুভূতির রশিতে তোমাদের লটকে রাখব।

এত কিছুর পরও যদি কোনো কাজ না হয়, তাহলে আমি আমার পরের চাল চালব। দুঃখ ও হতাশা দিয়ে তোমাদের জীবনকে বিষময় করে তুলব। দারিদ্রকে তোমাদের চোখে আত্মমর্যাদা হানিকর হিসেবে তুলে ধরব। ফলে তোমার অবস্থার উন্নতির জন্য তুমি তখন ধোঁকা দেবে। মিথ্যে বলবে। অন্যের অবস্থার উন্নতি দেখে তোমার মনে যাতে হিংসে জাগে আমি সেজন্য তোমাকে প্ররোচিত করব। তোমার মন তখন ভরে উঠবে মানসিক যন্ত্রণা আর হাহাকারে। নিজের মধ্যেই তখন তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।

আমি চলি তোমাদের শিরায় শিরায়।[৩] কামানা, বাসনা আর দুর্বলতার মধ্য দিয়ে আমি ঢুকব তোমাদের অন্তরে। খারাপ কাজের চিন্তা আর নানা আশঙ্কায় আমি তোমাদের মনকে ভরিয়ে তুলব। ভেঙে চুরচুর করে দেব তোমাদের দৃঢ়সংকল্প আর প্রতিরোধের ক্ষমতাকে। আমি তোমাদের নিচে নামিয়ে আনবই—এটা আমার ওয়াদা।

ভেব না আল্লাহর কাছে যাওয়ার পথে তোমরা আমাকে পরাস্ত করতে পারবে। আমি তোমাদের এমন কিছু দেখাব যা আগে কেউ দেখেনি। তোমাদের প্রভু তোমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আমি তোমাদের তা ভুলিয়ে দেব। অপরাধের গভীর অন্ধকারে চোবাব তোমাদের। তোমাদের বানাব আমার দাস। আর যখন তোমাদের উপলব্ধি হবে ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যাবে বাছা—কারণ তখন তোমরা হবে লাশ

আমি তোমাদের ঘৃণা করি। শুধু তোমাদের ক্ষতির চিন্তা করি। তোমাদের কীভাবে ধ্বংস করা যায় এই নিয়েই আমি আচ্ছন্ন। যখন বেঁচে থাকবে আমি তখন ছায়ার মতো তোমাদের সঙ্গী হয়ে থাকব। কিন্তু যখন আমার আদেশ মানতে মানতে তোমরা মারা যাবে তখন আর আমি তোমাদের সঙ্গ দেব না। তোমাদের ছেড়ে দেব তোমাদের প্রভুর হাতে। নিজেদের পাপের ফল নিজেরাই ভোগ করো এখন। তোমরা ছিলে দুর্বল! তোমরা ভুলে গিয়েছিলে তোমাদের প্রভুর দয়া, ভালোবাসা আর মমতা। ভুলে গিয়েছিলে তাঁর প্রতিশ্রুত জান্নাহ।

মনে রেখো, আমার সাথে তোমাদের জাহন্নামে হিঁচড়ে নিয়ে না-যাওয়া পর্যন্ত, তৃষ্ণায় কাতর না-করানো পর্যন্ত, আগুনে পুড়ে চামড়া না-ঝলসানো পর্যন্ত আমি তোমাদের ছাড়ছি না। জাহন্নামের আগুনে জ্বলে পুড়ে আর্তনাদ করার আগ পর্যন্ত আমার কোনো বিশ্রাম নেই।

তোমাদের ধ্বংস না-করা পর্যন্ত আমার নিস্তার নেই।

“তোমরা যারা বিশ্বাস করেছ, তারা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। যে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে তাকে তো শয়তান অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেবেই।” [৪]

মূল লেখিকা: আইশাহ আহমাদ

মূল লেখার লিংক: http://blog.islamiconlineuniversity.com/i-am-satan/

তথ্যসূত্র:

[১] সূরাহ আল-বাকারাহ, ২:৩৪

[২]  http://www.islamicbulletin.org/free_downloads/quran/stories_of_the_quran.pdf

[৩] আনা বিন মালিক বর্ণনা করেছেন, একবার আল্লাহর বার্তাবাহক (তাঁর উপর বর্ষিত হোক শান্তি ও আশীর্বাদ) তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। এমন সময় এক লোক তাঁদের পাশ দিয়ে গেল। নাবি সেই লোকটিকে ডেকে বললেন, “সে আমার স্ত্রী।” লোকটি বলল, “আল্লাহর বার্তাবাহক, আমি আপনাকে মোটেও সন্দেহ করিনি।” নাবি বললেন, “শয়তান অবশ্যই মানুষের শরীরে রক্তের মতো চলাচল করে।” — সাহীহ মুসলিম, ২১৭৪

[৪] সূরাহ আন-নূর, ২৪:২১

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *