একজন দা‘ঈর অন্যতম দায়িত্ব ইসলামের বার্তা স্পষ্ট করে পৌঁছে দেওয়া। মহান আল্লাহ আল-কুর’আনে বলছেন (অর্থের ব্যাখ্যা):
“তোমরা যদি (তোমাদের রাসূলকে) অবিশ্বাস করো, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই; কারণ তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলোও (তাদের রাসূলদের) অবিশ্বাস করেছিল। স্পষ্টভাবে বার্তা পৌঁছে দেওয়া ছাড়া রাসূলের আর কোনো দায়-দায়িত্ব নেই।” [সূরাহ আল-‘আনকাবুত, ২৯:১৮]
দা‘ওয়াহ দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে এই কাজে কোনো বিনিময় নেওয়া যাবে না। সূরাহ ইঊনুসে মহান আল্লাহ উল্লেখ করেছেন (অর্থের ব্যাখ্যা):
“আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও (আমার কথা মানতে রাজি না হও), তাহলে (জেনে রাখো), আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাইনি; আমার বিনিময় তো আল্লাহর কাছেই আছে; আর আমাকে (আল্লাহর) অনুগত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” [সূরাহ ইঊনুস, ১০:৭২]
মজার ব্যাপার হচ্ছে নাবি-রাসূলরা তাদের কোনো সম্পদ পরবর্তী বংশধরদের জন্য রেখে যান না। কারণ তাঁরা দুনিয়ার জন্য বাঁচেন না। তাঁরা এই দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন কাটান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
এজন্য তাঁরা তাঁদের সম্পদ কেন্দ্রীয় কোষাগারে (যদি থাকে) জমা দিয়ে দেন।
নাবি-রাসূলরা যে সম্পদ যে রেখে যান তা হচ্ছে জ্ঞান—আল্লাহর একত্বের জ্ঞান, ইসলামের জ্ঞান। আর এই জ্ঞানের উত্তরাধিকারী হতে পারেন যে কেউ। এজন্যই ইসলামি বিদ্বানদের (‘আলিম) বলা হয় নাবি-রাসূলদের উত্তরাধিকারী।
দা‘ওয়াহ দেওয়ার ক্ষেত্রে দা‘ঈদের অন্যতম যে গুণ থাকতে হবে তা হচ্ছে আন্তরিকতা। বলা হয় হৃদয়ের কথা হৃদয়ে পৌঁছায়। দা‘ঈ যদি তার দা’ওয়াহ্র সময় আন্তরিক না-হয়, অন্যে সঠিক পথে আসুক মন থেকে এই সদিচ্ছা তার মধ্যে না-থাকে; বরং বলতে হবে তাই বললাম এরকম মানসিকতা নিয়ে মানুষকে আহ্বান করে, তাহলে সবচেয়ে নিষ্ঠাবান মানুষটিও হয়তো তার আহ্বানে সাড়া দেবেন না।
সূরাহ ইয়াসীনে আমরা দেখি, তিনজন রাসূল পাঠানোর পরও যখন সেই জাতির লোকেরা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করছিল না, তখন নগরীর প্রান্ত থেকে এক লোক দৌড়ে এসেছিল শুধু একথা বলার জন্য যে,
“হে আমার জাতির লোকেরা, তোমরা রাসূলদের কথা মেনে নাও। এরা তো তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চায় না; বরং তারা সঠিক দিকনির্দেশনা প্রাপ্ত।” [সূরাহ ইয়াসীন, ৩৬:২১-২২]
কতটুকু আন্তরিকতা, সদিচ্ছা, মানুষকে সঠিক পথ পাওয়ানোর আকাঙ্ক্ষা থাকলে একজন মানুষ এভাবে শহরের প্রান্ত থেকে
ছুটে এসে দা‘ওয়াহ দিতে পারেন সেটা কি কল্পনা করা যায়?
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ
সাধারণভাবে একজন দা‘ঈর যে তিনটি উপকরণ প্রয়োজন তা হচ্ছে:
- সঠিক বুঝ
- দৃঢ় বিশ্বাস
- আল্লাহর সঙ্গে শক্তিশালী সংযোগ
সঠিক বুঝ
বলা হয়, আল-‘ইলমু কাবলাল-‘আমাল। কাজ করার আগে জানতে হবে। কিছু বলার আগে জানতে হবে কী বলছি। আল্লাহ যার ভালো চান,
তিনি তাকে দীনের বুঝ দান করেন। নিজের মধ্যে যদি দীনের সঠিক বুঝ না থাকে তাহলে অন্যকে কীভাবে বোঝানো সম্ভব?
সাহাবিদের থেকে এ ব্যাপারে পাওয়া যায় আকর্ষণীয় দৃষ্টান্ত। অনেক সাহাবিই নাবির (তাঁর উপর বর্ষিত হোক আল্লাহর শান্তি ও আশীর্বাদ) জীবদ্দশায় গোটা আল-কুর’আন মুখস্থ করেননি। অধিকাংশ সাহাবি দশটা করে আয়াত পড়তেন, বুঝতেন, নিজের জীবনে প্রয়োগ করতেন, এরপর এগোতেন। অথচ আমাদের মধ্যে এর উল্টোটাই বেশি দেখা যায়। অনেকে হয়তো গোটা আল-কুর’আন আরবিতে বহুবার খতম দিয়েছেন,
পুরো অনুবাদ পড়ে শেষ করেছেন, কিন্তু কিছুই বুঝেননি। নিজে না বুঝলে অন্যকে কীভাবে বোঝাবেন?
ইমাম আহমাদ বলেছেন যে, পানাহারের চেয়েও জ্ঞান বেশি প্রয়োজন। মানুষের জীবনে অক্সিজেন যেমন অপরিহার্য তেমনি একজন
আহ্বানকারীর জন্যও জ্ঞান অপরিহার্য। সূরাহ আলি-‘ইমরানের ১৮নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন যে,
মানুষদের মধ্যে যারা প্রকৃত অর্থেই জ্ঞানী কেবল তারাই এই সাক্ষ্য দেন যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য, উপাসনার যোগ্য নয়।
বিশুদ্ধ হাদীসে এসেছে:
যারা জ্ঞান অন্বেষণ করে আল্লাহ ও ফেরেশতারা তাদের জন্য দু‘আ করে।
দা‘ওয়াহর জন্য প্রথম উৎস হচ্ছে আল-কুর’আন। তাই আল-কুর’আনকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। হৃদয়ে লালন করতে হবে। আল-কুর’আন কেবল আরবিতে তিলাওয়াত হবে, খতমের পর খতম হবে এ উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয়নি। বরং মহান আল্লাহ বলেছেন (অর্থের ব্যাখ্যা),
“এটি একটি বারাকাহময় বই। আমি এটি তোমার কাছে অবতীর্ণ করেছি যাতে মানুষ এর আয়াতগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং বুদ্ধিমানেরা উপদেশ গ্রহণ করে।” [সূরাহ সাদ, ৩৮:২৯]
মোটা দাগে পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে।
ক. অবিশ্বাসী: এদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য খাওয়া, আনন্দ আর যৌন লালসা তৃপ্ত করা। দুনিয়ার মৌজ-মাস্তিই মূল লক্ষ্য এদের।
খ. বিশ্বাসী: এরা আল্লাহর একত্ব ও নাবি মুহাম্মাদের নুবুওওয়াতে বিশ্বাসী। এদের জীবনের মূল লক্ষ্য রাসূলুল্লাহ্র (তাঁর উপর বর্ষিত হোক আল্লাহর শান্তি ও আশীর্বাদ) সুন্নাহ (পথ ও পন্থা) মেনে আল্লাহকে
সন্তুষ্ট করা। এরা জীবনের মূল উদ্দেশ্যের ব্যাপারে সচেতন এবং সে অনুযায়ীই জীবনে সংগ্রাম করে যায়।
দুনিয়ার জীবনে সফল হওয়ার জন্য মহান আল্লাহ সহজ এক সূত্র বাতলে দিয়েছেন:
“তোমরা যারা বিশ্বাস করো, তারা রুকু ও সিজদাহ করো, তোমাদের প্রভুর ‘ইবাদাত করো এবং অন্যান্য সৎকর্ম করো; যাতে সফল হতে পারো।” [সূরাহ আল-হাজ্জ, ২২:৭৭]
নিঃসন্দেহে দা‘ওয়াহ বা মানুষকে ইসলামের দিকে ডাকা, ইসলামের আদেশ-নিষেধ স্মরণ করিয়ে দেওয়া উপরের আয়তে উল্লেখকৃত
সৎকর্মগুলোর মধ্যে একটি।
২. দৃঢ় বিশ্বাস
ইসলামের ব্যাপারে নিজের মধ্যে যেমন দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে, তেমনি এই বিশ্বাসও কঠিনভাবে ধারণ করতে হবে যে, আল্লাহর দীন সবার কাছে পৌঁছাবেই। কেউ না কেউ সেই কাজ করবেই। তাহলে আমি কেন বাদ যাবো? দা‘ওয়াহ দিতে গেলে অনেক বাধা-বিপত্তি, বিরোধিতা, বিদ্বেষ, সংঘর্ষের মুখোমুখি হতে হবেই। তাই বলে দা‘ওয়াহ দেওয়া থেকে বিরত থাকলে চলবে না। মনের মধ্যে সবসময় এই বিশ্বাস রাখতে
হবে যে, মানুষ কথা শুনবেই, দা‘ওয়াহ গ্রহণ করবেই। সব মানুষ হয়তো গ্রহণ করবে না, কিন্তু একজনকেও যদি ফেরানো যায় সেটাই বা কম কী?
দা‘ওয়াহ প্রথমে শুরু করতে হবে তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বের বাণী দিয়ে। বিশেষ করে অমুসলিমদের দা‘ওয়াহ দেওয়ার বেলায় এটা বেশি করে প্রযোজ্য। তাদেরকে বোঝাতে হবে সর্বময় কর্তা হিসেবে আল্লাহর একত্ব; উপাসনা পাওয়ার একমাত্র যোগ্য উপাস্য মহান আল্লাহ। আল্লাহর নাম ও গুণাবলির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা তাদের মধ্যে থেকে দূর করতে হবে। সর্বোপরি নিজের বিশ্বাসকে সবসময় সজীব রাখার জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করতে হবে:
يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِى عَلَى دِينِكَ
ইয়া মুক়াল্লিবাল-ক়ুলূব স়াব্বিত কালবি ‘আলা দীনিক
“হে হৃদয় পরিবর্তনকারী, আপনার দীনের উপর আমার অন্তরকে অটল রাখুন।”
বিশ্বাস ধরে রেখে ঈমানের মিষ্টতা পাওয়ার জন্য যে তিনটি কাজ করতে হবে:
ক. সবকিছুর চাইতে আল্লাহ ও তাঁর বার্তাবাহক মুহাম্মাদকে (তাঁর উপর বর্ষিত হোক আল্লাহর শান্তি ও আশীর্বাদ) ভালোবাসতে
হবে।
খ. আগুনে পোড়াকে মানুষ যেভাবে ভয় করে, ঘৃণা করে, বিশ্বাস থেকে অবিশ্বাসে চলে যাওয়াকেও সেভাবে ভয় করতে হবে, ঘৃণা করতে
হবে। এবং
গ. আল্লাহর জন্য মানুষকে ভালোবাসতে হবে।
৩. আল্লাহর সঙ্গে শক্তিশালী সংযোগ
সন্তান যখন মা’র দুধ পান করে, কোনো দয়াবান মা কি তখন পারবেন তার সন্তানকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে? আল্লাহর এর চেয়েও বেশি দয়াবান। তিনি কক্ষনো আমাদের ছেড়ে যাবেন না। সবসময় মনের মধ্যে এই বিশ্বাস
রাখতে হবে। আল্লাহ আমার সাথে আছেন এই বিশ্বাস ধরে রেখে মানুষকে অবিরাম দা‘ওয়াহ দিয়ে যেতে হবে। কোনোভাবেই হাল ছেড়ে দিলে চলবে না।
[ড. মুহাম্মাদ সালাহর এক লেকচার অবলম্বনে]