সেই হাদীসটির কথা আমরা অনেকেই হয়তো জানি—হাত দিয়ে না পারলে মুখ দিয়ে, মুখ দিয়ে না পারলে অন্তত অন্তর থেকে যেন ঘৃণা করি। এটা যদিও সবচেয়ে কমপরিমাণ ঈমানের পরিচায়ক, তবু এটা এমন একটা কাজ যা আমরা “সবাই” করতে সক্ষম।অনেকের হয়তো হাত দিয়ে কোনো অন্যায় বদলানোর সক্ষমতা নেই, কিংবা থাকলেও পারেন না। অনেকের হয়তো মুখ দিয়ে কোনো অন্যায় বদলানোর সক্ষমতা নেই, কিংবা থাকলেও পারেন না। কিন্তু এমন মুসলিম কি পাওয়া যাবে যিনি অন্তর থেকে কোনো অন্যায়কে ঘৃণা করতে সক্ষম নন?
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য: এমন মুসলিমের সংখ্যা আজ নেহায়েত কম নয়। কিন্তু তারচেয়েও সাংঘাতিক ব্যাপার হচ্ছে এমন লোকের মধ্যে দানা পরিমাণ ঈমানও আছে কি না সেটা এক বিরাট প্রশ্ন।
সাহীহ মুসলিমে লিপিবদ্ধ একটি হাদীসে নাবি (তাঁর উপর বর্ষিত হোক আল্লাহর শান্তি ও আশীর্বাদ) বলেছেন,
“আমার আগে যত নাবি পাঠানো হয়েছে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই তাঁদের জাতির মধ্য থেকে সাহায্যকারী ও সহচর ছিল। তাঁর পথ তারা অনুসরণ করত, তাঁর আদেশ বাস্তবায়িত করত। তাদের পর এমন এক প্রজন্ম এল যারা যা বলত তা করত না। আর যা করত তা বলত না। তাদের সঙ্গে যারা হাত দিয়ে সংগ্রাম করবে তারা বিশ্বাসী। তাদের সঙ্গে যারা জিহ্বা দিয়ে সংগ্রাম করবে তারা বিশ্বাসী। এবং তাদের সঙ্গে যারা অন্তর দিয়ে সংগ্রাম করবে তারাও বিশ্বাসী। এর বাইরে আর কোনো ঈমান নেই—এমনকি সর্ষেদানা পরিমাণও না।”
তাহলে বোঝা যাচ্ছে কারও মধ্যে যদি দানা পরিমাণ ঈমানও থাকতে হয়, তাহলে তাকে অন্তর দিয়ে হলেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। আর সেজন্য ইসলামে যাকিছু অন্যায় ও খারাপ হিসেবে নির্ধারিত সেগুলোর প্রতি অন্তরে ঘৃণা পোষণ করতে হবে।
অন্তরে ঘৃণা অক্রিয় (passive) কিছু নয়। সক্রিয়ভাবেই আসে এটা। শাইখ জামাল আদ-দীন যারাবোযো এ বিষয়ে চমৎকারভাবে বলেছেন:
“অন্তর পরিষ্কার রাখার এটা একটা উপায়। অন্তর যা দেখে এবং যা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক হয়, সেটা দ্বারা তা অবশ্যই আক্রান্ত হয়, প্রভাবিত হয়। আধুনিক প্রচারমাধ্যমগুলোর অন্যতম ক্ষতিকর দিক হচ্ছে, টেলিভিশন ও সিনেমায় মুসলিমরা এমন কিছু দেখেন যা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু যখন তারা লাগাতার সেগুলো দেখতে থাকেন তখন আর হৃদয়ে এ মন্দগুলো নিয়ে ঝাটকা লাগে না। খারাপকে তারা স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করে নেন। পরে যখন তারা অন্য মুসলিমদের তা করতে দেখেন—হয়তো তাদের সন্তানদেরকেও সেসব কাজ করতে দেখেন—কিন্তু এগুলো দেখে তাদের কোনো বিকার হয় না, তারা শঙ্কিত হন না। কারণ তারা ইতোমধ্যেই এগুলো গ্রহণ করার জন্য প্রভাবিত হয়ে গেছেন। আধুনিক জীবনের অংশ হিসেবে তারা এগুলোকে গ্রহণ করে নিয়েছেন।”[১]
আমাদের মধ্যে এমন কত জন আছি যারা নারী-পুরুষের “অবাধ” মেলামেশায় আজ আর কোনো খারাপ কিছু দেখি না। নারী ও পুরুষ উভয়েই পর্দার উপর “পর্দা” দিয়ে রেখেছি। ঘরোয়া আয়োজন থেকে শুরু করে, সামাজিক মেলামেশা, বিয়ে কিংবা যেকোনো পার্টি—নারী-পুরুষের “অবাধ” মেলামেশা এখন হরহামেশাই চোখে পড়ে। এখানে আমাকে কেউ ভুল বুঝবেন না যে, আমি নারী-পুরুষের পারস্পরিক যেকোনো ঘরোয়া বা সামাজিক যোগাযোগকে ধর্মের নামে নিষিদ্ধ বলছি। নারী ও পুরুষ প্রয়োজনে অবশ্যই পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করবে, সামাজিকতা রক্ষা করবে; তবে তা অবশ্যই ইসলামি জীবনব্যবস্থায় আল্লাহর দেওয়া বিধি মেনে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যখন এসব হয় ইসলামি বিধির কোনো তোয়াক্কা না করে।
না জানার কারণে, কিংবা সচেতনতার অভাবে ইসলামি পর্দাবিধি মেনে চলেন এমন অনেককেও দেখা যায় টেলিভিশনে ইসলামি পর্দবিধিপরিপন্থী বিভিন্ন অনুষ্ঠান অবলীলায় দেখে চলছেন। সন্তান যেন উঠতি বয়সে আবেগের বশে কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে না-পড়ে এজন্য অনেক মা-বাবাই সোচ্চার। কিন্তু রাতে একসাথে বসে তারাই যখন টেলিভিশনে প্রেমলীলা দেখেন তখন আর কীই-বা বলার থাকে। নাবি (তাঁর উপর বর্ষিত হোক আল্লাহর শান্তি ও আশীর্বাদ) হয়তো এদের ব্যাপারেই বলেছেন,
“…[এদের অবস্থা যেন] উল্টানো ধূসর রঙের টবের মতো। কোনটা ভাল তা শনাক্ত করতে পারে না। কোনটা খারাপ তা প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। বরং এরা প্রচণ্ড আবেগে বশীভূত।” (সাহীহ মুসলিম)
খারাপের সঙ্গে বসা থেকে যারা বিরত হন না, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ আরও কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন:
“তিনি তো [তাঁর] বইতে ইতোমধ্যেই তোমাদের বলে দিয়েছেন যে, তোমরা যখন আল্লাহ আয়াতসমূহকে অমান্য ও বিদ্রুপ করতে শুনবে তখন—যদি-না তারা অন্য কথা বলে—তোমরা তাদের সাথে আর বসে থাকবে না। নয়তো তোমরাও তাদের মতোই হবে: সব ভণ্ড আর অবিশ্বাসীদেরকে আল্লাহ জাহান্নামে জড়ো করবেন।” (সূরা আন-নিসা, ৪:১৪০)
খারাপ কাজ ঘটতে দেখলেও আমরা যদি তা ছেড়ে উঠতে না-পারি তাহলে আমরাও তাদের মতো হবো—এরচেয়ে ভয়ংকর কথা আর কী হতে পারে! অথচ বেশিরভাগ সময়ে আমরা এসব ক্ষেত্রে বসেই থাকি। আল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশ অমান্য হচ্ছে জেনেও আমরা সচেতন হই না। সজাগ হই না। উঠে সরে যাই না। কতটা বিকারহীন হলে এমনটা সম্ভব? ইসলাম সম্পর্কে কতটা বেখবর হলে এমনটা সম্ভব? ঈমান কতটা কম হলে এমনটা সম্ভব? আমাদের মধ্যে কি দানা পরিমাণ ঈমানও নেই?
যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে সময় হয়েছে জেগে ওঠার। ইসলাম সম্পর্কে জানার। মর্টিমাল অ্যাডলার লিখেছেন, “জ্ঞানের উপরই নির্ভর করে বিচক্ষণ কাজ”। কাজেই শুধু জানলেই হবে না, তা মানার ইচ্ছা থাকতে হবে। আন্তরিক চেষ্টা থাকতে হবে। তবেই না সেই জানার পরিপূর্ণতা। আর এভাবেই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে আমাদের ঈমান। একদিন বিশাল গাছে রূপ নেবে আমাদের সেই দানা পরিমাণ ঈমান।
তথ্যসূত্র:
[১] যারাবোযো, জামাল আদ-দীন, কমেন্ট্রি অন দ্যা ফোরটি হাদিথ অফ আন-নাওয়াউই, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১০০৭। ইউএসএ, আল-বাশীর কোম্পানি ফর পাবলিকেশনস অ্যান্ড ট্র্যান্সলেশনস।