বইয়ের পর বই পড়ছেন, অথচ কী পড়ছেন তা পরেরদিনই আরেকজনকে বলতে পারছেন না। ‘ভাই, অমুক বইটা খুব ভালো’, এভাবে বলা শুরু করলেন, ‘অনেক কিছু জানতে পারবেন, খুব ভালো লাগবে। পড়ে দেখেন।’ কিন্তু বইটা কেন ভালো, ভেতরে কী বলা আছে তা আর স্পষ্ট করে মনে করতে পারছেন না। দুতিন সপ্তাহ পর শুধু মনে আছে যে ‘অমুক’ নামে একটা বই পড়েছিলেন; কিন্তু ভেতরের বিষয়বস্তু এক বিন্দুবিসর্গ মনে নেই—নিজের জীবনে প্রয়োগ করা তো পরের কথা।
যা হোক, নিজেকে এলিয়েন মনে করে কষ্ট পাওয়ার কোনো কারণ নেই। জ্বরের মতো এই অসুখ আমাদের বইপড়ুয়াদের অতি সাধারণ অসুখ।
ঘরে ব্যায়ামের যাবতীয় রসদ কিনে ফেলে রেখে দিলে ৬ মাস পর কেন, ৬ বছর পরও আয়নার সামনে দাঁড়ালেও যেই কে সেই—কোনো পরিবর্তন খুঁজে পাবেন না। হাতিয়ার ব্যবহার করতে না জানলে বা ব্যবহার না করলে মিসাইল নিয়ে বসে থাকলেও বোমা হামলার শিকার হবেন। যদি আসলেই আয়নায় দাঁড়িয়ে সিক্স প্যাক দেখতে চান, নিজেকে নিয়ে গর্ব করতে চান, জ্ঞানকে আপনার সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে চান তা হলে আগে বাড়ুন।
ব্যাক টু বেসিক
প্রথমে কিছু মৌলিক কথা: কলেজ বা ভার্সিটির পাঠ্যবই যেভাবে পড়েছেন প্রথমে সেভাবে বই পড়া ভুলে যান। আত্ম-উন্নয়ন বা নিজের জ্ঞান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এই যে বই পড়ছেন, আপনাকে এজন্য দু ঘন্টার কোনো টেস্ট দিতে হবে না। কাজেই বাদ্রের ময়দানে লড়াইটা ঠিক কোন মাসে হয়েছিল, বা সেখানে ঠিক কতজন মুসলিম অংশ নিয়েছিল, কতজনই বা শহিদ হয়েছিল সেটা জানা আমাদের মূল উদ্দেশ্য না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঠিক কয়টা সেক্টর ছিল, প্রত্যেক সেক্টর কার অধীনে ছিল, সেখানে কতজন বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন তার চেয়ে জানা জরুরি সেক্টর কমান্ডারের কোনো বিশেষ কৌশলের কারণে একটা খণ্ড লড়াই তারা জিতে নিয়েছিলেন। বা ঠিক কী ভুলের কারণে নিজেদের বেশি সংখ্যক লোকের প্রাণহানি হয়েছিল।
ফ্যাক্টস বা উপাত্তগুলো অন্তর্জাল ফুঁড়ে বা বইয়ের নির্ঘণ্ট বা সূচি থেকে পরে যেকোনো সময় সহজে বের করে নেওয়া যাবে। আমাদের আসল উদ্দেশ্য শাঁস বের করা। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলী কোন বছরে নোবেল পুরস্কার পেল, তার চেয়ে গীতাঞ্জলীর সাহিত্যের কোন মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়ে নোবেল পাওয়ার যোগ্য হলো, বা আসলেই এটা যোগ্য ছিল কি না, এই পুরস্কারের পেছনে অন্য কোনো স্বার্থ কাজ করেছে কি না—সেগুলো জানলে আমরা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এগোতে পারব। আমাদের মেধার ধার বাড়বে।
হিয়ার ইজ য়োর সিক্রেট রেসিপি
পৃথিবীর তাবত বই, মর্টিমার অ্যাডলারের মতে, দুই ধরনের: তাত্ত্বিক, ব্যবহারিক। কিছু বইতে উভয়ের মিশ্রণ পাবেন। ভালো বইগুলোতে আসলে তত্ত্ব ও প্রয়োগ দুদিকের কথাই বলে থাকে। পুঁজিবাদের মডেল জানার সাথে সাথে দৈনন্দিন জীবনে এটা কীভাবে প্রয়োগ করবেন সেটা না জানলে মাঝ নদীতে ঝড়ের কবলে পড়া সেই পুঁথিগত বিদ্যার-ঢেকি পণ্ডিতের মতো অবস্থা হবে।
বই পড়ার আগে, অধ্যাপক রন ফ্রাই বলছেন, উদ্দেশ্য ঠিক করে নিন। কেন পড়ছেন? এই লেখাটা পড়ে আর কিছু যদি মাথায় না নেন, নিয়েন না; শুধু এটুকু মাথায় রাখুন: ‘কেন?’
সারা বিশ্বের বেশিরভাগ মুসলিম কুরআন পড়ে সাওয়াবের নিয়তে। ওয়েল, সাওয়াব বা শুধু পুরস্কারের উদ্দেশ্যে কুরআন পড়াটাকে খারাপ বলা যায় না, কিন্তু আমাদের নবিজি ﷺ থেকে শুরু করে সাহাবি বা পরবর্তী বিদ্বানগণের কেউ ‘শুধু’ সাওয়াবের জন্য কখনো কুরআন পড়েছেন এমন নজির পাওয়া যায় না। তারা কুরআন পড়তেন, সাথে সাথে মর্মার্থ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতেন, কীভাবে একটু পর এ আয়াতটা কাজে লাগাবেন সেটা ঠিক করে নিতেন। ‘উমার বিন খাত্তাব এজন্য ১২ বছর লাগিয়েছিলেন শুধু সূরা বাকারাহ মুখস্থ করতে। আল্লাহ দিলে উনাদের স্মরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিল; কিন্তু তারপরও এত সময় লাগার কারণ প্রতিটা আয়াতের প্রয়োগ বুঝে বুঝে এগিয়ে যাওয়া।
তো আজ সন্ধ্যায় যখন সকালে কিছু অংশ পড়ে ফেলে রাখা বইটা আবার হাতে নেবেন, বা টেবিল থেকে নতুন কোনো বই তুলে নেবেন, তখন নিজেকে জিজ্ঞেস করুন: কেন এই বইটি পড়ছি। বইটি পড়ে আমি কী জানতে চাই। আমার জীবনের কোনো অংশের উন্নতির জন্য এ বইয়ের শিক্ষা কাজে লাগাতে চাই।
ইসলামি ‘ইবাদাতের নিয়ত যেমন মুখে বলতে হয় না, এগুলোও মুখে বলার দরকার নেই—বই পড়া শুরুর আগে স্রেফ মাথার র্যামে প্রশ্নগুলো রেখে বই পড়া শুরু করুন। এরপর পড়তে পড়তে দেখবেন আপনার অবচেতন মন ঠিক সেই ‘কেন’গুলোর উত্তর ব্রেনের ফ্রন্টাল লোব বা অস্থায়ী স্মৃতিতে ধারণ করছে। কুরআন পড়েও কেন কিছু মানুষ ভুল বার্তা পায় এখন কী তার কিছুটা বোঝা যাচ্ছে? গোড়ায় গলদ আর কি।
আজকে সকালেই এক ভাইয়ের সঙ্গে কথা হলো। তিনি কোনোভাবেই তার এত সুন্দর বইটা দাগাতে চাচ্ছেন না! আমি জানি এই শূচিবায় রোগ আমাদের অনেকের। দেখেন বই আপনার আসবাব বা লেটেস্ট গ্যাজেট না যে চাদরে মুড়িয়ে বা স্ক্রিন গার্ড দিয়ে প্রটেক্ট করে রাখতে হবে। সংরক্ষণের জন্য বাইরের যত্নআত্তি লাগলেও, অন্তত ভেতরের পাতায় কাটাকুটি কেন করা হবে না এই মর্মে কারণ দর্শান।
মর্টিমার অ্যাডলার, হাউ টু রিড আ বুকের রচয়িতাদের একজন, আমাদের এই সংস্কার ভেঙে দিতে যেয়ে বলছেন বই পড়া মানে বইয়ের লেখকের সঙ্গে কথা বলা। সামনাসামনি কারও সঙ্গে কথা বললে যেমন সায় দিয়ে মাথা নাড়ান, কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে কথা বলেন, ভালো না লাগলে উঠে চলে যান—বই পড়ার বিষয়টাও ঠিক তেমন। আপনি এক অদৃশ্য লেখকের সঙ্গে কথোপকথনে মগ্ন। কল্পনা করুন, আজ থেকে শত শত বছর আগে, টিমটিমে আলোআধারী কুঠুরিতে এক শশ্রুমণ্ডিত বিদ্বান দোয়াতে চুইয়ে চুইয়ে কাগজের পাতায় জমিয়ে রেখেছেন আমাদের নবিজির কথামালা, সেগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ—আজ ২০১৮ সালে পাকা দালানের ভেতর বিছানায় কাত হয়ে ডিজিটালি প্রিন্ট হয়ে ছেপে আসা সেসব রত্নভাণ্ডার পড়ে অভিভূত হচ্ছেন। অদৃশ্য সেই লেখকের দরদ কি আপনি শুনতে পাচ্ছেন?
ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং আল্লাহর কথা, মানে কুরআন আর তাঁর বার্তাবাহকের যেসব কথা বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত, মানে সহীহ সুন্নাহ—সেগুলো বাদে দুনিয়ার আর সবকিছুর সাথে আপনি দ্বিমত, ত্রিমত করতে পারেন। আপনি পাঠক হিসেবে যত সজাগ বা অ্যাকটিভ থাকবেন তত বেশি আপনার মধ্যে ভিন্নমত বা যুক্তি দানা বাঁধবে। দ্বিমতটা এখানে দ্বিমতের খাতিরে না, মানে করতে হবে বলে করা না—আপনি লেখকের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সাথে একমত হতে পারছেন না সেজন্য দ্বিমত করছেন। সবসময় দ্বিমত করবেন তা-ও হয়তো না। একমতও হতে পারেন। মার্জিনে তখন লিখে ফেলুন না, সাবাশ ব্যাটা। আপনার পার্সোনাল বই কে যাচ্ছে দেখতে। আবার আপাতত মতামত স্থগিত রেখে লিখে রাখতে পারেন, আরও গবেষণা লাগবে।
তো এই যে এক একটা ভিন্ন চিন্তা মাথায় এল, এটাকে নিয়ে কী করবেন? যদি তরতর করে পড়ে বই শেষ করে ফেলেন, কখন যে কোন ছাইয়ের গাদায় ওই চিন্তা হারিয়ে যাবে তা আর কস্মিনকালেও খুঁজে পাবেন না। এজন্য যখনই কোনো ভাবনা আসবে বইয়ের মার্জিনে লিখে রাখুন। ভাই, এই বই আপনার বউ না। দুর্বল আর মূর্খ মানুষ তো তার বউয়ের গায়েও হাত তোলে, আর আপনি জ্ঞান সংরক্ষণের জন্য অপরূপ বইয়ের পাতাতেও লিখতে পারবেন না? না হয় একটা দামি কলম কিনে নিন বইয়ে লেখার জন্য, তবু লিখুন।
অনেকে আন্ডারলাইন বা হাইলাইটসের কথা বলেন। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং পশ্চিম পাড়ার অনেক বিশেষজ্ঞের লেখা পড়ে বুঝেছি: শুধু নিচে দাগ দিয়ে রাখলে বা রং-বেরঙের হাইলাইট করে রাখলে পরে এসে বেশিরভাগ সময়েই আর মনে থাকে না ঠিক কী কারণে দাগিয়ে ছিলাম। এজন্য দুচার শব্দে হলেও লিখে রাখুন কেন দাগালেন।
একটা মজার কথা বলি। সৈয়দ শামসুল হকের ‘কথা সামান্যই’ বইয়ের একটা লেখাতে তিনি তার মায়ের স্মৃতিচারণ করে বেশ কিছু কথা লিখেছিলেন। তো লেখাটার শেষ করলেন এভাবে যে, জান্নাতে শুধু পুরুষদের জন্য হুর থাকে। নারীদের জন্য কিছু নেই। আমি ওই জায়গাটা দাগিয়ে মার্জিনে লিখে রেখেছিলাম, আপনি মূর্খ। নারীদের জন্য কী আছে সেটা আপনার জানা নেই। আপনারা জানতেও চান না।
কথা হচ্ছে লেটস হ্যাভ সাম ফান। বইটা একান্তই আপনার নিজের সম্পদ। তো কারও কথার সাথে একমত হলে যেমন মার্জিনে লিখতে পারেন, ‘বস, সেরাম লিখছেন’, তেমনি কারও কথার সাথে দ্বিমত হলে লিখতে পারেন, ‘হালা ফাউল।’ যেহেতু ব্যক্তিগত সম্পদ, এখানে কারও কোনো ‘সে’ নাই। বইটাকে আপনি নিজের মনে করে সকল ভাবনা লিখতে থাকুন। দেখবেন পড়তে যেয়ে অন্যরকম মজা পাচ্ছেন।
আপনি যদি ‘ব্রাহ্মণ’ হন, কোনোভাবেই দাগ তরিকার পথ মাড়াতে না চান, কিংবা পিডিএফ বই পড়েন, তা হলে কী করবেন? ত্রাতা হিসেবে আছে আমাদের সবসময়ের নাছোড়বান্দা সঙ্গী: আপনার প্রিয় অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস। স্মার্ট ফোনের সবচেয়ে আনস্মার্ট ব্যবহারে আমরা সিদ্ধহস্ত। অন্তত বই পড়ার বেলায় আসুন এর স্মার্ট ব্যবহার করি।
অ্যান্ড্রয়েডে এভারনোট, ওয়াননোট খুবই পেশাদার ও উন্নতমানের অ্যাপ। বইয়ের কোনো অংশ পড়ে যখন যা মনে আসে এখানে লিখে রাখুন। আজীবনের জন্য সেইভ হয়ে থাকবে ইনশা আল্লাহ। আর এগুলো তালাশযোগ্য হওয়ায়, কখনো কোনো চিন্তা সহজেই খুঁজে পাবেন এখানে। অ্যাপগুলোর উইন্ডোজ ও ম্যাক সংস্করণও আছে। কাজেই সবসময় নিজের নোট আঙুলের কাছে পাবেন।
কানে কানে এই ফাঁকে বলে রাখি আমি শরীরি মানে ফিজিক্যাল বই পড়লে পাতা দাগাই বটে, কিন্তু নোট তুলি অ্যান্ড্রয়েডে। এর কিছু মারাত্মক উপকার আছে, শেষে বলব।
বইয়ের মার্জিনে না লেখার আরেকটা আকর্ষণীয় বিকল্প হচ্ছে পোস্ট ইট নোট ব্যবহার। একটু অভিজাত বা রুচিশীল স্টেশনারিগুলোতে এগুলো পাবেন। জিনিসগুলো চিকন ও লম্বা এক ধরনের স্টিকি নোট। বুকমার্ক হিসেবে যেমন ব্যবহার করতে পারবেন, তেমনি ওগুলোতে প্রাসঙ্গিক চিন্তা লিখে বইয়ের পাতায় সেঁটে দিতে পারবেন। নোটের দিঘল অংশটা থাকে পাতা থেকে বাইরে। যেকারণে দরকারমতো সহজেই দরকারি জায়গা খুঁজে পাবেন।
অনলি সিক্স প্যাক ইজ রিয়েল
কী হবে এত কষ্ট করে যদি দুদিন পর সব নদীর পারের মতো জলের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়? কদিন ব্যায়াম করে যখন প্যাক উঁকিবুকি করছিল, তখন যদি ব্যায়াম ছেড়ে দেন, তা হলে যে সব পণ্ডশ্রম। আমি নিজে একসময় বেশ কিছু বই পড়েছি, নোট করেছি; কিন্তু ‘ক্লাউড ব্যাকআপ’ সিস্টেমের মতো কোনো সিস্টেম দাঁড় করাইনি বলে সেসব বই নিয়ে কিছু বলতে গেলে পুরো নোটস ঘেঁটে দেখতে হয়। তবু এতটুকু রক্ষা যে নোটগুলো ছিল। কিন্তু মুসলিমরা ‘এতটুকু’তে ক্ষান্ত হবে কেন?
স্পেসড রিপিটেশান বা বিরতি দিয়ে দিয়ে ঝালাই করার একটা সিস্টেম অধুনা পশ্চিমা পাড়া আবিষ্কার করেছে; কিন্তু আমাদের কুরআন ও হাদীসের হাফিযরা সেই কবে থেকে এটা চর্চা করে আসছেন! হাজার হাজার কুরআনের আয়াত আর লাখ লাখ হাদীস যারা মাথার হার্ড ডিস্কে জমা করে রাখেন, তাদের কর্মপদ্ধতি খেয়াল করলে দেখবেন তারা সকালের মুখস্থ করা আয়াত রাতে রিভাইজ করেন। নতুন দিন নতুন আয়াত মুখস্থ করার আগে গতকালের আয়াত ঝালাই করে নেন। আধা পাতা মুখস্থ হলে নতুন করে বাকি আধা পাতা মুখস্থ শুরু করার আগে সেটা ঝালাই করে নেন। এভাবে নিয়মিত বিরতিতে তারা আগের অংশ ঝালাই করে মজবুত করে নেন।
আধুনিক গবেষণা সেই পদ্ধতির সায় দিয়ে বলছে, যদি আপনি কোনো পড়া মুখস্থ করতে চান—আমাদের বেলায় সেটা হচ্ছে কোনো বইয়ের মূল চিন্তাগুলো—তা হলে যেদিন পড়েছেন সেদিন রাতে নোটগুলো একবার রিভাইজ করবেন। এরপর পরেরদিন। এরপর ৩ দিন পর। এরপর ১ সপ্তা পর। এরপর ১ মাস, ২ মাস, ৬ মাস পর। একাধিক গবেষণায় এই বিরতির কিছু হেরফের পেলেও মূল কথা হচ্ছে বিরতি দিয়ে দিয়ে রিভিশান।
জাদুটা হচ্ছে স্মৃতি থেকে যখন কোনো কিছু হারিয়ে যায় যায় অবস্থা, তখন সেটা মনে করার চেষ্টা করলে গাঁথুনি আগের চেয়ে মজবুত হয়। ফ্রন্টাল লোবের অস্থায়ী বা স্বল্পমেয়াদি স্মৃতি তখন হিপোক্যাম্পাস বা স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিতে স্থানান্তরিত হয়। র্যামে রাখা তথ্য সলিড স্টেট ড্রাইভে জমা হয়। এখন শুধু ক্লাউড সিঙ্ক করলেই খেলা ফাইনাল।
এই কিছুদিন আগে আমি অ্যান্ড্রয়েডে মাইন্ড জিপ নামে একটা অ্যাপ পেয়েছি। এই অ্যাপটা আপনার সব দামি দামি চিন্তাকে নিয়মিত বিরতিতে মনে করিয়ে দিয়ে ঝালাই করিয়ে দেবে। আপনার সিক্স প্যাক হওয়াকে তখন আর ঠেকায় কে? উপরে বলেছিলাম না নোটস অ্যাপে সেইভ করার বিশেষ সুবিধা আছে। সুবিধা হলো সহজে আপনি কপি-পেইস্ট করে এই অ্যাপে নিয়ে আসতে পারবেন।
অফলাইনে সহজে এ কাজটা কীভাবে করবেন তা আমার জানা নেই। যদি কেউ জানেন মন্তব্যের ঘরে জানাতে পারেন।
প্যাক বানানোর আরেকটা ভালো উপায় হচ্ছে কোনো অধ্যায় পড়া শেষ হলে সেটার একটা সংক্ষিপ্তসার সাথে সাথে লিখে ফেলুন। এরপর পুরো বই শেষ করে গোটা বইয়ের রিভিউ লিখে ফেলুন। ছোটবেলায় শুনে এসেছেন না যে লিখলে পড়া মনে থাকে বেশি? ছোটবেলার সব কথা কিন্তু ফেলনা নয়। এ কথাটা আসলেই সত্য। কদিন আগে পদার্থবিজ্ঞানী ফাইনম্যানের একটা বই শেয়ার দিয়েছিলাম। তার সূত্র ছিল: একটা বিষয় পড়ে সেটা আসলেই রপ্ত হয়েছে কি না তা বোঝার জন্য একটা সাদা কাগজ নিন। তারপর সে বিষয়টার শিরোনাম লিখে কিশোর বয়সী কারও উপযোগী করে বিষয়টা নিয়ে লিখুন। মনে করুন আপনি তাকে বোঝাচ্ছেন। যদি ঠিকঠাকমতো কাজটা করতে পারেন, তা হলে বুঝবেন আপনি আসলেই বুঝেছেন। না হলে আপনি হ্যাঙোভার অবস্থায় আছেন। বিদ্যাবোঝাই বাবুমশাই সেজে নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছেন অনেক পড়েছি। কিন্তু আসলে আপনার মধ্যে কোনো শাঁস নেই, আছে শুধু আঁশ।
নলেজ ইন অ্যাকশন
আমাদের চতুর্থ খলীফা ‘আলী বলেছেন জ্ঞান কাজের মধ্যে তার প্রয়োগ চায়। আপনি ন্যায়পর সাহাবিদের শাসনব্যবস্থা ও শাসনকাল নিয়ে পিএইচডি করেছেন, কুরআনের ব্যাখ্যায় পোস্টডক করেছেন (আমি জানি কারও কারও ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে যে এসব বিষয়ে আবার পিএইচডি-ফিএইচডি আছে নাকি। আছে—ইসলাম এমনি এমনি পশ্চিমের মাথাব্যাথা না), অথচ আপনার কাজেকর্মে সুবিচার নেই, সদয়াচরণ নেই; সত্যের সমর্থনে গা জোয়ারি শক্তির মুখে পেছনে পড়ে থাকেন, হুজুর হুজুর স্বভাব বাদ দিতে পারেননি, তা হলে আপনার সব জ্ঞান শূন্য কলসি। আপনি ডিমক্র্যাসির নানা অসংগতি জেনেও বেটার সল্যুশান না খুঁজে ওটাকে তেল দিচ্ছেন, তা হলে আমার চোখে আপনি একজন একজন ভাঁড়। আপনার চিন্তাচেতনায় জ্ঞান যদি ন্যূনতম প্রভাব ফেলতে না পারে তা হলে আপনি সালমান খান। আপনার এই সিক্স প্যাক পরিচালকের নির্দেশ মেনে যখন তখন টি-শার্ট খুলে দেখিয়ে বেড়ানোর জন্য। আপনার নিজের কিবা জনমানুষের কল্যাণের জন্য নয়।
র্যাপিং ইট আপ
বই নিয়ে কথা বলার জন্য এত এত কথা পেটের ভেতর গুলগুলি খেলছে যে বই পড়া নিয়েই একটা বই লিখে ফেলতে পারব ইনশা আল্লাহ। আপাতত বই পড়ার কেবল প্র্যাকটিক্যাল এবং সবচে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা নিয়ে কথা বললাম সংক্ষেপে। কিন্তু সংক্ষেপ করতে পারলাম কই?
আমার কাছে নন-ফিকশন বইগুলোকে মনে হয় একেকটা পাওয়ার। গল্প-উপন্যাস বা কল্পনা সাহিত্যের বইগুলো মানুষের মনন উন্নত করতে বা তার ব্যক্তিজীবনকে সুন্দর করতে, তার চলার পথে শক্তি জোগাতে কতটা ভূমিকা রাখে তা নিয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান। আমার নিজের জীবনে স্রেফ ভাষার ব্যবহার শেখানো ছাড়া এদের আর কোনো ভূমিকা পাইনি। সেজন্য বই পড়ে যদি আপনার মস্তিষ্ককে পেশিবহুল করতে চান, মেধার রাইফেলে বুলেট জমাতে চান তা হলে বেশি বেশি আত্মউন্নয়নমূলক, প্রায়োগিক জ্ঞানমূলক বই পড়ুন।
এক জায়গায় বলে নিয়েছিলাম এই লেখাটা পড়ে যদি আর কিছু না নেন, অন্তত ‘কেন’ পড়ছেন সেটা নেন, তা হলেই যথেষ্ট। আজ রাতে যে বইটা হাতে নেবেন, বা আপনার টু-বাই লিস্টে যে-বইগুলো রেখেছেন, সেগুলো নিয়ে একটু ভাবুন: এই বইগুলো আমার সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করতে কতদূর এগিয়ে নেবে? যদি ইতিবাচক উত্তর পান তা হলে এগিয়ে যান। না হলে স্রেফ সালমান খান হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না।