নিতি অনেকক্ষণ ধরে মাছটার দিকে তাকিয়ে আছে। এঁকেবেকে সারা অ্যাকুরিয়াম চষে বেড়াচ্ছে। কখনো অন্য মাছের সাথে গুতোগুতি করছে। কখনো ধাওয়া করছে কোনো কারণ ছাড়াই। সুরুৎ সুরুৎ করে পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে এদিকওদিক। চকিতে ঘুরে আবার ধাওয়া করছে। মনে হচ্ছে যেন কাচের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। আহ! নিতি যদি এমন পারত!
অ্যাকুরিয়ামের নিচের দিকে এক কৃত্রিম গাছের আড়ালে একটা মাছ লুকিয়ে আছে। ধাওয়া খেতে খেতে ক্লান্ত। লেজের অংশটা একটু ছিঁড়ে গেছে। হয়তো ঐ ধাওয়াকারী মাছটা কামড়ে দিয়েছে। আচ্ছা, ও কি ব্যথা পেয়েছে? কান্না করছে? মাছের কান্না দেখা যায় না কেন?
“নিতি, টেবিলে আসো। খাবার রেডি। গরম গরম ইলিশ ভাজা। তাড়াতাড়ি খাও। সেইরকম টেস্ট!”, বাবার ডাকে নিতির ভাবনায় ছেদ পড়ল।
টেবিলে আজ হরেক রকম খাবার। ভাতের সাথে নানারকমের ভর্তা। এর অনেকগুলোর নাম নিতি জানে। টিভিতে যদিও পান্তাভাতের কথা ছিল, কিন্তু ওরা পান্তা ভাত খেতে পারে না। গতবছর খেয়ে ফুড পয়জনিং হয়েছিল সবার। তরকারি বলতে কেবল ভাজা ইলিশ মাছ। একদম তাজা মাছ। কাল রাতে নিতির বাবা কিনে এনেছেন। ভাজা ইলিশের গন্ধে ডাইনিং রুমটা ভরে আছে।
নিতির বাবার ইদানিং খুব নামডাক। ব্লগে অনেকদিন ধরে লেখালেখি করেন। কিন্তু এতদিন লাইমলাইটে আসতে পারেননি। এবার এলেন।
কদিন আগে কোরবানি ঈদ গেল। ঈদে আনন্দের দোহাই দিয়ে গোহত্যা নিয়ে ধারাবাহিক কিছু ব্লগআর্টিকেল লিখেছেন। জনপ্রিয় এক ব্লগ সাইটে সেগুলো প্রকাশিত হয়েছে। এরপর থেকেই তিনি হিট। এক আর্টিকেলে লিখেছেন, “ইদের আগের দিন রাতে প্রতিটা কোরবানির পশুর চোখ দিয়ে জল ঝড়ে পড়ে। সকালে ধর্মান্ধরা মসজিদে যেয়ে পশুহত্যার সবক নিয়ে আসে। এরপর আরাধনা শেষে মহাধুমধামের সাথে পশুহত্যাযজ্ঞে নামে। চারিদিকে রক্তবন্যায় ভাসায়। এ কেমন উৎসব? এ কেমন আনন্দ? এর নামই ইদ! থু এইসব ধর্মান্ধদের উপর।”
সেই ব্লগপোস্ট নিয়ে অনলাইনে তুলকালাম বেধে যায়। পক্ষে-বিপক্ষে চলতে থাকে কমেন্টের লড়াই। ঐ পোস্টটা যেদিন দিলেন, তার পরদিন থেকে নিতিদের বাড়িতে নতুন কিছু লোকের আনগোনা শুরু হয়। নিতি দেখেছে, এদের সাথে বাবা দীর্ঘ সময় নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকের মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝে না যদিও। বৈঠকের এক পর্যায়ে মা তাদের জন্য নাস্তাপানি নিয়ে যান। মা’ও যোগ দেন তাদের সঙ্গে।
“মাছের মাথাটা খাও। ইলিশের মাথার অন্যরকম স্বাদ। আগে তো খাওনি কখনো। এবার খেয়ে দ্যাখো।” মা নিতির মাটির প্লেটে মাছের মাথাটা দিলেন। নকশা করা সুন্দর মাটির প্লেট। আড়ং থেকে কেনা। প্লেটের সাথে গ্লাস, বাটি, জগগুলোও মাটির। পুরো গ্রামীণ আবহ রেপ্লিকেট করার চেষ্টা।
নিতি দেখল মাছটা কেবন রোবটের মতো ওর দিকে তাকিয়ে আছে একপাশের চোখ দিয়ে। ভাবলেশহীন।
মাছটা উল্টাল। একই চিত্র। তবে এই চোখটা একটু পুড়ে গেছে। কোটরের সাথে লেগে কিছুটা বের হয়ে ঝুলে আছে। মাছটা কি এখনো বেচে?
“বাবা, মাছটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেন?”
“তাকিয়ে থাকবে কেন? মাছ ভাজলে কি আর জ্যান্ত থাকে নাকি। মাছের চোখ সবসময় খোলা থাকে, স্কুলে পড়োনি?”
“আচ্ছা বাবা, মাছটাকে কাটার সময় ও কি কান্না করেছে?”
মেয়ের এরকম উদ্ভট প্রশ্নে বাবার গলায় কাঁটা বিধে গেল। মা বাবাকে এক লোকমা সাদাভাত গিলে খেতে বললেন। প্রথম লোকমায় গেল না। আরেক লোকমা খেলেন। এবার গেল মনে হচ্ছে।
“আবোলতাবোল না বলে খাও তো। মাছ আবার কান্না করবে কেন। মাছের চোখে পানি নেই।”
“ও!”
টেবিল ছেড়ে নিতি দৌড়ে অ্যাকুরিয়ামের কাছে গেল। পাখনা-ছেড়া মাছটা তখনও ঐ গাছের আড়ালে। সে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল। মাছটা গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে। নিতি খেয়াল করল মাছটা পলকও ফেলছে না। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। ধাওয়াকারী মাছটা যখন ওর পাখনা ছিঁড়ে ফেলল, তখন কি ও কষ্ট পায়নি? কষ্ট না পেলে এভাবে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকবে কেন? আমরা তো কষ্ট পেলে কাঁদি। ওরা কী করে?
“নিতি, কী ব্যাপার, টেবিল ছেড়ে উঠলে কেন? আমরা একটু পর বাইরে বের হবো। তোমার মনে হয় যাওয়ার ইচ্ছা নাই, তাই না?” নিতির মা হাঁক ছাড়লেন।
নিতি উঠল না। সে হাঁটু ভেঙে দুপা ছড়িয়ে বসে পড়ল। অ্যাকুরিয়ামের আরও কাছে ঘেঁষল। মাছটা নির্বিকার। বোকার মতো চেয়ে আছে। স্বচ্ছ পানিতে উপরে-নিচে দুলে দুলে ভাসছে।
“কী হলো, নিতি? আসছ না কেন এখনো?” বাবা চোখ বড় করলেন।
মা বললেন, “মাথা না-খেতে মন চাইলে পেটের চাক খাও। আমি কাঁটা বেছে দিচ্ছি।”
নিতির পেটের চাক অনেক পছন্দ। কাঁটা কম এটা একটা কারণ। স্বাদও বেশি। অনেক পেটের চাকে তৈলাক্ত একটা অংশ থাকে। ওটা খেতে নিতির খুব ভালো লাগে।
পেটের চাক দেখে নিতির আগে অবাক লাগত। মাছের বেশিরভাগ চাকগুলো ত্রিভুজ আকারের। কিন্তু পেটের চাকগুলো অনেকটা চারকোণা। চারকোণা করে কীভাবে কাটে? গতকাল সেই রহস্য দূর হয়েছে। রাতে যখন বাবার সাথে কাচা বাজারে গিয়েছিল তখন দেখেছে কীভাবে মাছ কাটা হয়।
সারি সারি চার-পাঁচটা ইলিশ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাছওলা বলল তাজা মাছ। একটু আগেই ধরে আনা। আশেপাশে আরও কিছু নাম না জানা মাছ। পানির অভাবে তড়পাচ্ছে। কিছু শিং মাছকে দেখল শুকনো থালাতেও কুর্দন করছে। বাবা মাঝারি সাইজের তাজা ইলিশ কিনলেন একটা। কেটে পিস পিস করে দিতে বললেন।
নিতি পিটপিট চোখে মাছ কাটার দৃশ্য দেখেছে। পাখনাগুলো বটির উপর ধরে কাঠের ছোট একটা মুগুড় দিয়ে বাড়ি দিতেই নিচে পড়ে গেল। চারপাশের পাখনা কাটার পর পুরো মাছটার আঁশ ছাড়ানোর জন্য আলপিনের সুঁচালো ব্রাশ দিয়ে ঘষা হলো। ঘষায় ঘষায় ঝাঁঝড়া হয়ে গেলে মাছটার শরীর। আঁশগুলো খসে খসে পড়তে লাগল। মাছের মাথা কেটে কানসা থেকে ফুলকা বের করা হলো। মাছওলার হাত রক্তে চুপচুপ। মাছের চোখ দুটো তখনো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে।
মাছটির চোখে কোনো জল ছিল না।