আমার বয়স যখন ১৭, তখন একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বপ্নে দেখছিলাম, আমি একটা মাসজিদের ভেতর বসে আছি। ছোট্ট এক মেয়ে কোত্থেকে যেন দৌড়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা বলো তো, মানুষ কেন একজন আরেকজনকে ছেড়ে যায়?” প্রশ্নটা শুনে ভাবলাম, আরেহ এটা তো আমারই প্রশ্ন; আমাকেই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে! পরে বুঝতে পেরেছিলাম প্রশ্নটা কেন আমাকে করা হয়েছিল।
মানুষের সাথে আমি খুব বেশি মিশে যেতাম। সম্পর্কগুলোর মায়ায় জড়িয়ে যেতাম।
ছোটবেলা থেকেই আমার মনমেজাজ ছিল অন্যরকম। অন্যান্য ছেলেমেয়েদের স্কুলে দিয়ে তাদের বাবা-মা’রা যখন চলে যেত, ছেলেমেয়গুলো সহজেই সেটা সামলে উঠতে পারত। কিন্তু আমি কেন যেন পারতাম না। একবার চোখের পানির ফোয়ারা শুরু হলে সেটা যেন আর বাধ মানতে চাইত না। বড় হতে হতে চারপাশের সবকিছুর মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে নিতে লাগলাম। ক্লাস ওয়ান থেকেই আমার মনে হচ্ছিল আমার একজন বান্ধবী দরকার। আরেকটু বড় হলাম। বান্ধবীদের সাথে এটা ওটা নিয়ে মাঝে মধ্যে ঝগড়া হতো, খুব খারাপ লাগত আমার। সবকিছুর মায়াতেই জড়িয়ে যেতাম: মানুষ, নতুন জায়গা, স্মরণীয় ঘটনা, ছবি, মুহূর্ত—এমনকি কোনো কাজের ফলাফলের সাথেও জড়িয়ে পড়তাম আমি। আমি যেভাবে চাইতাম, বা যেভাবে কল্পনা করতাম সেভাবে যদি না হতো, তাহলে কেমন যেন লাগত। হতাশায় ভেঙে পড়তাম। একবার পড়ে গেলে আর উঠে দাঁড়াতে পারতাম না। ভুলতে পারতাম না, ক্ষত আর শুকাত না। যেন একটা কাঁচের ফুলদানি। টেবিলের এক কোণায় রাখা। একবার ভেঙেছে তো আর জোড়া লাগার কোনো উপায় নেই।
কাঁচের তৈরি ফুলদানি, সে তো ভাঙবেই। একবার কেন বারবারই ভাঙবে। কিন্তু সমস্যা তো ফুলদানির নয়। এতবার ভাঙার পরও আমি যে বারবার ফুলদানিটা টেবিলের কোণায় রাখতাম, আসল সমস্যা তো এটাই। আমার চাওয়া-পাওয়া পূরণের জন্য অন্য মানুষগুলোর উপর, তাদের সাথে আমার সম্পর্কের উপর খুব বেশি নির্ভর করতাম। আমিই এসব সম্পর্ককে সুযোগ করে দিয়েছিলাম আমার সুখ-দুঃখকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। আমার চাহিদা, শূন্যতা পূরণ করার জন্য। আমাকে নিরাপত্তা আর আত্মমর্যাদাবোধ দেওয়ার জন্য। টেবিলের কোণায় ফুলদানি রেখে ওটা ভাঙার ব্যবস্থা যেভাবে আমি নিজের হাতে করে দিয়েছিলাম, ঠিক সেভাবে এসব সম্পর্কের উপর অতিমাত্রায় নির্ভর করে আমি নিজেই আমার হতাশার কবর খুঁড়েছি। ভাঙার জন্য আমি নিজেই আমাকে ঠেলে দিয়েছি। আর এসবের কী সুন্দর প্রতিদানই-না আমি পেয়েছি: একটা হতাশার পর আরেকটা হতাশা, একবার ভেঙে পড়ার পর আবার ভেঙে পড়া।
সম্পর্কগুলো ভেঙে পড়ার জন্য আমি মোটেও সেই মানুষগুলোকে, সেই সম্পর্কগুলোকে দায়ী করব না। কোণায় রাখলে ফুলদানি তো ভাঙবেই, এখানে ফুলদানির কী দোষ! গাছের ছোট ডালের উপর ভর করলেই হলো? ওটা কি আর আমার মতো কাউকে ধরে রাখতে পারে?
যদি সত্যিকার অর্থেই কেউ আমাদের আশ্রয় দিতে পারেন, তবে সেটা আল্লাহ ছাড়া আর কে। তিনি বলেছেন (ভাবার্থ), “যারা মন্দকে প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহকে সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করেছে তারা এমন এক বিশ্বস্ত হাত ধরেছে, যেটা কখনো ভাঙবার নয়। আল্লাহ তো সব শোনেন, সব জানেন।” (কুরআন ২:২৫৬) খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা শিক্ষা আছে এই আয়াতে: কেবল একটি হাতলই আছে যেটা কক্ষনো ভাঙে না। কেবল একটি জায়গায়ই আছে যেখানে আমরা আমাদের সব নির্ভরতাকে ছেড়ে দিতে পারি। কেবল একটি সম্পর্কই আছে যেটা বলে দিতে পারে আমাদের প্রকৃত আত্ম-মর্যাদাবোধ কীসে। কেবল সেই সম্পর্ক থেকেই আমরা আমাদের জীবনের চূড়ান্ত সুখ, পূর্ণতা ও নিরাপত্তা পেতে পারি। কোন সেই সম্পর্ক? সেই সম্পর্ক হচ্ছে মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্ক।
আর আমরা কিনা সেগুলো খুঁজে ফিরি এই দুনিয়াতে। কেউ খোঁজে তার ক্যারিয়ারের মধ্যে, কেউ খোঁজে সম্পদের মধ্যে, কেউ-বা আবার সামাজিক মর্যাদার মধ্যে। আবার আমার মতো কেউ হয়তো খোঁজে বিভিন্ন সম্পর্কের মধ্যে। এলিজাবেথ গিলবার্ট তার খাও, প্রার্থনা করো, ভালোবাসো বইতে লিখেছিলেন তিনি কীভাবে তাঁর সুখ খুঁজতেন। এক সম্পর্ক ছেড়ে আরেক সম্পর্ক গড়ে, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে ঘুরে তিনি তার জীবনে পরিপূর্ণতা খুঁজতেন। বিভিন্ন সম্পর্কের মধ্যে, ধ্যানের মধ্যে এমনকি খাওয়া-দাওয়ার মধ্যেও তিনি তার চাওয়া-পাওয়া খুঁজে ফিরেছেন। কিন্তু দিনশেষে সবজায়গা থেকেই ফিরেছেন ব্যর্থ হয়ে।
আমিও ঠিক একই কাজ করেছি। নিজের ভেতরের শূন্যতা এগুলোর মাধ্যমে পূরণ করার চেষ্টা করেছি। ছোট্ট সেই মেয়েটি যে তাই এই প্রশ্নটাই করবে ওটাই তো স্বাভাবিক। এই প্রশ্ন ছিল না পাওয়ার বেদনা থেকে, হতাশা থেকে। এই প্রশ্ন নিজের ভেঙে পড়ার প্রশ্ন, কোনো কিছু খুঁজে শেষে খালি হাতে ফেরার প্রশ্ন। এটা যেন অনেকটা খালি হাতে ইটের দালান খোঁড়ার মতো: খালি হাতে তো ফিরবেনই, নিজের আঙুলেরও বারটা বাজাবেন। আর এগুলো আমাকে কোনো বই কিংবা কোনো জ্ঞানী লোকের কথা শেখায়নি। আমাকে শিখিয়েছে আমার হতাশা, আমার বেদনা।
ছোট্ট সেই মেয়েটির প্রশ্ন আসলে আমারই প্রশ্ন…আমি নিজেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছি।
প্রশ্নটা আসলে এই দুনিয়ার বাস্তবতা নিয়ে। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী কিছু মুহূর্ত আর ক্ষণিকের কিছু সম্পর্ক নিয়ে। এই দুনিয়াতে আমাদের আশেপাশের মানুষগুলো আজ আছে তো কাল নেই। হয় দূরে কোথাও চলে যায়, কিংবা মারা যায়। কিন্তু বাস্তবতা আমাদের কষ্ট দেয়, কারণ এটা আমাদের স্বভাববিরুদ্ধ। মানুষ হিসেবে আমাদের স্বভাবই হলো এমন, যা কিছু নিখুঁত ও দীর্ঘস্থায়ী সেগুলোকে চাওয়া, সেগুলোকে ভালোবাসা কিংবা সেগুলো পাওয়ার জন্য চেষ্টা করা। চিরস্থায়ী কোনো কিছুকে আঁকড়ে ধরাই আমাদের স্বভাব। আমরা চিরস্থায়ী কিছু খুঁজে ফিরি কারণ, দুনিয়ার জীবনের জন্য তো আমাদের সৃষ্টি করা হয়নি; আমাদের প্রথম ও প্রকৃত বাড়ি তো জান্নাতে: ওটা যেমন নিখুঁত তেমনি চিরস্থায়ী। কাজেই এমন জীবনের স্বাদ খোঁজা আসলে আমাদের মানবপ্রকৃতিরই একটি অংশ। সমস্যা হচ্ছে আমরা সেটা এই দুনিয়াতে খুঁজি। আর তাই বুঝি আমরা বয়সকে ধরে রাখার জন্য চামড়ায় যেন বলিরেখা না-পড়ে সেজন্য ক্রিম কিনি। কসমেটিক সার্জারি করি। আমরা দুনিয়াকে জান্নাত বানাতে চাই; সেটা কি হয় কখনো?
মনকে যখনই দুনিয়ার মায়ায় বেশি জড়িয়ে ফেলি তখন সেটা ভেঙে যায়। দুনিয়া আমাদের কষ্ট দেয়। কারণ, দুনিয়া মানেই হলো যেটা ক্ষণস্থায়ী, ত্রুটিপূর্ণ। আমাদের মনের মাঝে যে-আকাঙ্ক্ষা আল্লাহ পুরে দিয়েছেন সেটা কেবল কোনো চিরস্থায়ী নিখুঁত জিনিস দিয়েই পরিপূর্ণ হতে পারে। ক্ষণিকের কোনো কিছু দিয়ে সেটা পূরণ করতে যাওয়ার মানে হলো মরিচীকার পানি দিয়ে তেষ্টা মেটানো। খালি হাতে দালান ভাঙা। প্রকৃতিগতভাবে যেটা ক্ষণস্থায়ী সেটাকে চিরস্থায়ী রূপ দেওয়ার চেষ্টা অনেকটা আগুন থেকে পানি বের করার মতো। আগুনের ধর্মই জ্বালিয়ে দেওয়া। ওটা থেকে কি তৃষ্ণা মেটানো যায়! যখনই দুনিয়ার আশা আমরা ছেড়ে দেব একমাত্র তখনই আমরা এই পার্থিব জীবনে মন ভাঙার মতো কঠিন যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হতে পারব। দুনিয়া জান্নাহ নয়, সেটা কখনো হবেও না।
আমাদের বুঝতে হবে, কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া কিছু হয় না। কিছুই না। মন ভাঙার পেছনে কারণ আছে। কষ্ট পাওয়ার পেছনেও কারণ আছে। এই ভাঙা হৃদয় আর কষ্টের মধ্যেই আমাদের জন্য শিক্ষা ও আল্লাহর প্রজ্ঞার নিদর্শন আছে। কিছু একটা যে ভুল হচ্ছে, আমাদের যে বদলাতে হবে এগুলো তারই সতর্কবার্তা। আগুনে হাত পুড়ে যেতে থাকলে আমরা তো এই সতর্কবার্তাই পাই যে আমাদের হাত সরাতে হবে। তেমনি মানসিক দুঃখকষ্টগুলোও আমাদের এই কথাই বলে যে, আমাদের ভেতরটাকে বদলাতে হবে। কিছু একটা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে। যন্ত্রণা আমাদের বাধ্য করে বিচ্ছিন্ন হতে। ভালোবাসার কোনো মানুষ যখন বারবার আমাদের কষ্ট দেয় তখন যেমন আমরা তার থেকে দূরে সরে যাই, ঠিক তেমনি এই দুনিয়া যত বেশি আমাদের কষ্ট দেয় তত বেশি আমরা অনিবার্যভাবে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।
কোনো কিছু থেকে কষ্ট পেলে বোঝা যায় কীসের মায়ায় আমরা বেশি জড়িয়ে আছি। যে-জিনিসটা আমাদের কাঁদায়, বেশি কষ্ট দেয় বুঝতে হবে সে জিনিসের সাথেই আমাদের মায়া জড়িয়ে আছে। অথচ আমাদের দরকার আল্লাহর মায়ায় জড়ানো। আর যে-জিনিসগুলো আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়তে বাধা দেয় সেগুলো থেকে দূরে থাকা। এসব যন্ত্রণাই আমাদের জীবনের মিথ্যে মায়াকে স্পষ্ট করে তোলে। দুঃখ-কষ্ট আমাদের জীবনে এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি করে। আমরা এই জটিল অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজি। নিজেদের বদলানোর ব্যাপারে আমাদের যদি যথেষ্ট মানসিক শক্তি না থাকে তাহলে কুরআনের এই কথাই যথেষ্ট (ভাবার্থ): “আল্লাহ কখনো কারও অবস্থা বদলাবেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।” (কুরআন ১৩:১১)
বছরের পর বছর ধরে মানুষের কাছ থেকে কষ্ট পেতে পেতে একসময় ধরতে পারলাম আমার মূল সমস্যা কোথায়। সবসময় ভেবে এসেছি দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা মানে হলো দুনিয়াবি বিভিন্ন জিনিসের মায়ায় জড়িয়ে থাকা। আমি ভাবতাম, দুনিয়ার প্রতি আমার কোনো আসক্তি নেই। আমি তো শুধু কিছু মানুষের মায়ায় পড়ে আছি। কিছু ঘটনা, কিছু মুহূর্ত, কিছু আবেগ—এগুলোও কি দুনিয়াবি? তো আমি ভাবতাম আমি দুনিয়ার মায়ায় জড়িয়ে নেই। কিন্তু আমি আসলে বুঝিনি যে এই মানুষগুলো, কিছু মুহূর্ত, আবেগ এগুলো সবই দুনিয়ার অংশ। আমি একেবারেই বুঝতে পারিনি যে, আমার জীবনে আমি যে-অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি এগুলোর পেছনে কারণ একটাই, শুধু একটাই: দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা।
যখন বুঝতে পারলাম তখন মনে হলো আমার চোখের সামনে থেকে যেন একটা পর্দা সরে গেল। মূল সমস্যা কোথায় সেটা নিজের চোখে দেখতে পারলাম: আমি চাচ্ছিলাম দুনিয়ার জীবনকে কষ্টহীন নিখুঁত করতে; কিন্তু তা তো কখনো হওয়ার নয়। কিন্তু ঐ যে একবার ওভাবে জীবনটাকে ভেবে নিয়েছিলাম, তাই জীবনটাকে কষ্টহীন করার জন্য, নিখুঁত করার জন্য আমি আমার রক্ত, ঘাম, চোখের জল জলাঞ্জলি দিয়েছিলাম। জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছিলাম দুনিয়াকে জান্নাহ বানানোর জন্য।
সম্পর্কগুলো থেকে আমার প্রত্যাশা ছিল আমার আশেপাশের মানুষগুলো একদম ভালো হবে। আমার সম্পর্কগুলো খুব সুন্দর হবে। আমার জীবন ও আমার আশেপাশ থেকে কতকিছুই না আশা করেছিলাম। কত আশা, কত সাধ, কত স্বপ্ন। জীবনে অসুখী হওয়ার পেছনে যদি একটিমাত্র কোনো রেসিপি থাকে তাহলে সেটা হলো: আশা। আমার জীবনের চরম ভুল ওটাই। হ্যাঁ আশা করাটা ভুল না; কারণ মানুষ হিসেবে আমাদের কখনোই নিরাশ হওয়া উচিত না। তবে ভুলটা ছিল আমি “কোথায়” আশা-ভরসা করেছিলাম? দিনশেষে আমার আশা-ভরসা আল্লাহর উপর ছিল না। আমার আশা-ভরসা ছিল মানুষের উপর, মানুষের সম্পর্কের উপর। আমার ভরসা ছিল দুনিয়ার উপর, আল্লাহর উপর না। এভাবেই একসময় আমি কঠিন একটা সত্য বুঝতে পারলাম। কুরআনের একটা আয়াত বারবার আমার মাথায় ঘুরতে লাগল। আয়াতটা আগেও অনেকবার শুনেছি, তবে প্রথমবারের মতো আমি বুঝতে পারলাম এ আয়াতটি যেন আমাকে নিয়েই: “যারা আমার সাথে সাক্ষাতের আশা রাখে না বরং দুনিয়ার জীবন নিয়েই সন্তুষ্ট আছে এবং যারা আমাদের নিদর্শনসমূহ নিয়ে গাফেল হয়ে আছে, তাদের কৃতকর্মের জন্যই তাদের স্থান হবে জাহন্নামে।” (কুরআন ১০:৭)
দুনিয়াতেই সব পাবো—এমন চিন্তাভাবনার মাধ্যমে আমি আসলে আল্লাহর উপর ভরসা করিনি। আমার ভরসা ছিল এই দুনিয়ার উপর। দুনিয়া ছেড়ে আল্লাহর উপর ভরসা করার মানে কী?
এর মানে হলো, দুনিয়াতে আপনার যত বন্ধুই থাকুক না কেন, কখনো ভাববেন না যে আপনার বন্ধুরা আপনার শূন্যতা দূর করবে। যখন বিয়ে করবেন, তখন আশা করবেন না যে, আপনার সব প্রয়োজন আপনার সঙ্গী মেটাবে। যখন কোনো কাজ করবেন, ফলাফলের উপর আশা করবেন না। কোনো সমস্যায় পড়লে ভাববেন না, আমি একাই এর সমাধান করে ফেলতে পারব। অন্যের উপরও নির্ভর করবেন না। কেবল আল্লাহর উপর ভরসা করুন।
মানুষের সাহায্য নিন—তবে মনে রাখবেন কোনো লোক (কিংবা আপনি নিজেও) আপনাকে রক্ষা করতে পারবেন না। কেবল আল্লাহই আপনাকে রক্ষা করতে পারবেন। আল্লাহই এই মানুষগুলোকে আপনার সাহায্যের জন্য পাঠান। কিন্তু এরা আপনার সাহায্যের উৎস নয়, আপনার পরিত্রাণের উৎস নয়। একমাত্র আল্লাহই আপনাকে সাহায্য করেন, আপনাকে রক্ষা করেন। মানুষ তো এমনকি একটা মাছির পাখাও সৃষ্টি করতে পারে না (২২:৭৩); আপনার কী উপকার করবে! পরস্পরের সঙ্গে যখন কথা বলবেন, তখনও আল্লাহর দিকে নিজের মনকে ফিরিয়ে রাখুন। নাবী ইব্রাহিম আলায়হিস-সালাম কি সুন্দরভাবেই না বলেছেন, “মহাবিশ্ব ও পৃথিবী সৃষ্টিকারী সেই মহান আল্লাহর দিকেই আমি একনিষ্ঠভাবে আমার মুখ ফেরালাম। এবং আমি কক্ষনো তাঁর সাথে কোনো শরীক করব না।” (কুরআন ৬:৭৯)
নাবী ইব্রাহিম আলায়হিস-সালাম কীভাবে এমন মানসিক অবস্থানে পৌঁছালেন? তিনি গভীরভাবে চাঁদ, সুর্য ও তারকার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি দেখেছেন, এরা কেউই ত্রুটিমুক্ত না। এরা অস্ত যায়, আমাদের ছেড়ে চলে যায়। এভাবে ভেবেচিন্তেই তিনি আল্লাহর দিকে নিজের মুখ ফিরিয়েছেন।
আমাদেরও এভাবেই পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে। নির্ভর করতে হবে। আস্থা রাখতে হবে। যেদিন সেটা করতে পারব, সেদিন বুঝতে পারব অন্তরের প্রশান্তি আর স্থিরতা কাকে বলে। যে উঁচুনিচু গিরিপথ আমাদের জীবনকে তাল-বেতাল করে দিচ্ছিল সেই পথে আমাদের আর চলতে হবে না। কেননা আমাদের হৃদয় যদি এমন কিছুর উপর নির্ভর করে, এমন এক সত্ত্বার উপর নির্ভর করে যিনি অবিচল, তাহলে আমাদের হৃদয়ও হবে অবিচল। আর আমরা যদি এমন কিছুর উপর নির্ভর করি যেটা নিজেই সবসময় বদলে যাচ্ছে, যেটা ক্ষণস্থায়ী তাহলে আমারাও হবো অস্থির, উত্তেজিত। অর্থাৎ এই হয়তো আমরা কোনো কিছু নিয়ে খুশি হলাম, কিন্তু যেই-না আমাদের খুশির কারণ বদলে গেল, অমনি আমাদের খুশি ছুটে গেল। আমরা আবার মনমরা হয়ে পড়লাম। একবার এদিকে দুলি কি আরেকবার ওদিকে। বুঝতেও পারি না কেন এমন হচ্ছে।
যতদিন না আমরা চিরস্থায়ী ও অবিচল কোনো সত্ত্বার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করছি ততদিন আমরা নিজেরা স্থির হতে পারব না। এমন তাল-বেতাল হতেই থাকবে। আমরা কীভাবে আশা করি যে, যেটা একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে, যেটা নিজেই অস্থির তার উপর ভরসা করলে আমাদের মন শান্ত হবে? সাহাবা আবু বাক্রের একটা কথার মধ্যে এ ব্যাপারটা আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়।
নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু `আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মারা গেলেন, লোকজন তখন এতটাই শোকাহত যে, তারা কোনোভাবেই খবরটা মেনে নিতে পারছিলেন না। নাবী সাল্লাল্লাহু `আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে কেউ যদি খুব বেশি ভালোবেসে থাকেন, তাহলে সেটা আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহুম। যার ভালোবাসা বেশি তার কষ্টটাও বেশি। নাবী সাল্লাল্লাহু `আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি এত ভালোবাসা থাকার পরও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সত্যিকার অর্থে কার উপর আমাদের ভরসা করা উচিত। তিনি বললেন, “আপনারা যদি মুহাম্মাদের উপাসনা করে থাকেন, তাহলে মন দিয়ে শুনুন তিনি মারা গেছেন। আর আপনারা যদি সত্যিই আল্লাহর ইবাদাহ করে থাকেন, তাহলে জেনে রাখুন, আল্লাহ কক্ষনো মারা যান না।”
মানসিক প্রশান্তির এই স্তরে পৌঁছাতে হলে আপনাদের যা করা দরকার: আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সম্পর্ককে আপনাদের কোনো অভাব পূরণের উৎস হতে দেওয়া যাবে না। আমাদের জীবনের সাফল্য, ব্যর্থতা কিংবা আত্ম-মর্যাদা আল্লাহ ছাড়া আর কারও সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। যদি এটা করতে পারেন তাহলে আর কখনোই আপনি ভেঙে পড়বেন না। কারণ আপনি যাঁর হাত ধরেছেন, তাঁর হাত কক্ষনো ভাঙার নয়। আপনাকে আর কেউ হারাতে পারবে না। কীভাবে হারাবে? কারণ আপনি যাঁর উপর নির্ভর করেছেন তাকে কি কেউ হারাতে পারে? আপনি কক্ষনো শূন্যতা অনুভব করবেন না। কীভাবে করবেন? কারণ আপনার পরিতৃপ্তির উৎস কখনোই ফুরাবে না, কমবে না।
আজ আমি যখন আমার সেই ১৭বছরে দেখা স্বপ্নটার কথা মনে করি, তখন ভাবি সেই ছোট্ট মেয়েটি কি আমিই ছিলাম! এমনটা ভাবার কারণ হলো, জীবনের পরবর্তী যন্ত্রণাকাতর বছরগুলোতে ঠেকে ঠেকে যেই নিদারুণ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল, সেই সময়টায় এই উত্তরটা আমার জন্য ছিল একটা টনিকের মতো। মানুষ কেনে ছেড়ে চলে যায় এ প্রশ্নের উত্তরে আমি তাকে বলেছিলাম: “কারণ দুনিয়ার জীবন তো জান্নাত নয়। যদি হতো তাহলে পরকালের জীবনকে কী বলা হতো?”