আমি তো নবি না, আমাকে দিয়ে ওসব হবে না

confused guy

আমরা যখন অনেক মুসলিমদের ইসলামের বিভিন্ন বিধির কথা বলি, তারা বলে বসেন, “আরেহ, তিনি তো ছিলেন নবি, আমরা তো আর নবি না, আমাদের দিয়ে কী ওসব হবে।” 

এ ধরনের জবাবের সমস্যা দুটো।

১. হীনমন্যতা। এটা শুধু ইসলামি বিধির ক্ষেত্রে না, অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেও হতে পারে। যেমন কারও সামনে যদি আইনস্টাইনের উদাহরণ তুলে ধরা হয়, তাহলে হয়তো তিনি বলবেন, “আমি কি আর আইনস্টাইন?”

উঠতি কোনো খেলোয়াড়কে যদি সাকিব আল-হাসানের উদাহরণ দেওয়া হয়, তিনি হয়তো বলবেন, “আমি কি আর সাকিব?”

সমস্যাটা এখানে মানসিকতায়। আমরা ধরেই নিয়েছি আমাদের দিয়ে উৎকর্ষ অর্জন সম্ভব না। আমরা ছাপোষা মানুষ। নিত্যদিন যা করি, তা-ই নিয়ে কোনোমতে জীবনটা পার করে দিলেই হলো। স্বপ্ন কিংবা কোনো কিছু নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমাদের মনে কাজ করে না। তার পরিবর্তে চেপে ধরে আমাদের নিজেদেরই তৈরি করা সীমাবদ্ধ বিশ্বাস।

২. সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে আমরা এটা বুঝি যে, নাবি-রাসূলরা ছিলেন আল্লাহর বিশেষ মনোনীত ব্যক্তি। তাঁরা যা পেরেছেন বা করেছেন তা হুবুহু আমাদের পক্ষে করা কখনোই সম্ভব না। তা-ই বলে আমরা কি থেমে থাকব?

নাবি (তাঁর উপর বর্ষিত হোক আল্লাহর শান্তি ও অনুগ্রহ) যে-পরিমাণ মনোযোগ নিয়ে সালাত আদায় করেছেন আমরা হয়তো সেভাবে সালাত আদায় করতে পারব না, তাই বলে কি আমরা সালাত আদায় ছেড়ে দেব? আমরা কি তখন এই খোঁড়াযুক্তি দেব যে, “আমি তো নবি না, আমার নামাজ নবিজীর মতো হবে না। কাজেই আমার নামাজ পড়ে কী লাভ।”

না, তখন আমরা এটা বলব না। কারণ, আমরা জানি সালাত আদায় অবশ্যকর্তব্য। সাওয়াবের দিক দিয়ে কেউ হয়তো বেশি, কেউ হয়তো কম পাবেন। কিন্তু সালাত তো আমাদের আদায় করতেই হবে।

এটা অন্যান্য ইসলামি বিধির বেলাতেও খাটে।

আমি নাবির মতো সব ভালো কাজ করতে পারব না বলে কোনো ভালো কাজই করব না এটা খুবই হাস্যকর যুক্তি।

এধরনের পরিস্থিতিতে আরেকটি তর্ক পাওয়া যায়: ধরুন, কাউকে দাড়ি রাখার কথা বলা হলো। তিনি হয়তো যুক্তি দেখাবেন, আরও কত কাজ আছে সেগুলো করি না, শুধু দাড়ি রেখে কী হবে। কিংবা “নবিজী তো আরও অনেক কিছু বলে গেছেন, আগে সেগুলো করি, এরপর এটা করব।”

এগুলো সবই আসলে অজুহাত। সচেতন কিংবা অবচেতনভাবে আমরা আমাদের নিজেদেরকে ধোঁকা দিচ্ছি। আন্তরিকভাবে নিজের মনকে প্রশ্ন করলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে।

সচরাচর অনেকে আরেকটা যুক্তি দেখান: “আরেহ, এখন কি আর সেই সময় আছে?” আচ্ছা একটু চিন্তা করে বলুন তো, আল্লাহর নাবিকে যদি আজ পাঠানো হতো, তাহলে তিনি কি আল-কুর’আনের আদর্শকে ঠিক সেভাবেই অনুসরণ করতেন না, যেভাবে তিনি ১৪০০ বছর আগে করেছিলেন? নাবি ‘ঈসা (তাঁর উপর বর্ষিত হোক আল্লাহর শান্তি) যখন আবার আসবেন তিনি কি নাবি মুহাম্মাদের (তাঁর উপর বর্ষিত হোক আল্লাহর শান্তি ও আশীর্বাদ) আদর্শই অনুসরণ করবেন না? আর আপনার কি মনে হয়, যখন নাবি ‘ঈসা আবার আসবেন তখন পৃথিবীর সামগ্রিক পরিস্থিতি এখনের চেয়ে ভালো হবে না খারাপ? বিশ্বাসীদের জন্য তখন পরিস্থিতি হবে আরও নাজুক। কাজেই আগেকার দিনে অমুক-তমুক কাজ করা গেছে, এখন আর সম্ভব না—এ ধরনের যুক্তিও নিছক অজুহাত।

সুমহান আল্লাহ সবাইকে নাবি করে পাঠাননি। আমাদের সামনে নাবিকে দিয়েছেন অনুকরণীয় আদর্শ বা রোল মডেল হিসেবে। 

বাংলাদেশে এমন বহু যুবককে পাওয়া যাবে যারা সালমান খানকে অনুকরণ করেন। তিনি যেভাবে রোদচশমা গলার পেছনে ঝুলিয়ে রাখেন সেভাবে তারাও ঝুলিয়ে রাখেন। এতে করে তারা সালমান খান হয়ে যায় না। তারা সেই দাবিও করেন না। কিন্তু সালমান খানের প্রতি ভালোবাসা, ভালোলাগা থেকেই তারা এগুলো করেন। অথচ এই ভালোলাগা, ভালোবাসায় পার্থিব কিছু বাসনা পূরণ হলেও, পরকালে এর ফলাফল খুবই ভয়াবহ। কেননা বিচারদিনে মানুষেরা তাদের সঙ্গেই পুনরুত্থিত হবে, যাদেরকে সে ভালোবাসে, যাদেরকে সে অনুসরণ করে।

আমরা যদি নিজেদেরকে মুসলিম দাবি করি, তাহলে অবশ্যম্ভাবীভাবে এটা আমাদের করণীয় হয়ে দাঁড়ায় যে, আমরা আমাদের প্রিয় নাবি মুহাম্মাদকে (তাঁর উপর বর্ষিত হোক আল্লাহর শান্তি ও অনুগ্রহ) অনুসরণ করব। অনুকরণ করব। আমরা এতে করে নাবি হয়ে যাব না—সেটা অসম্ভব—কিন্তু আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে তাঁর কাছাকাছি যাওয়া। ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করা। 

আল-কুর’আনে সুমহান আল্লাহ নাবিকে উত্তম আদর্শ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আদর্শ তাকেই বলা হয়, যার নিক্তিতে অন্যকে বিচার করা হয়। আমাদের নাবি হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ভালো কাজ ও ইসলামের প্রতি আন্তরিকতায় তাঁর আদর্শ অনুসরণে আমরা কতটুকু তাঁর কাছাকাছি পৌঁছাতে পারলাম সেটাই মূল লক্ষ্য।

উপরের প্রতিটা খোঁড়াযুক্তির পেছনে দায়ী আমাদের হীনমন্যতা। দায়িত্ব ও কর্তব্য ছেড়ে পালানোর অভিসন্ধি।

ব্যাপারটা যদি স্রেফ হীনমন্যতা হয়ে থাকে, তাহলে নিজের মনকে জানিয়ে দিন, আল্লাহ কারও উপর তার সাধ্যাতীত বোঝা চাপিয়ে দেন না। আপনি পাঁচবার সালাত আদায় করতে পারবেন, ইসলামি জীবন ব্যবস্থা মেনে চলতে পারবেন—এইভাবে প্রোগ্রাম করেই আল্লাহ আপনাকে, আমাকে সৃষ্টি করেছেন। ইহসান বা ‘ইবাদাতে উৎকর্ষ অর্জন করতে পারবেন—এভাবেই আপনাকে, আমাকে বানানো হয়েছে। এজন্য চাই চেষ্টা, লেগে থাকা এবং নিজের সামর্থ্যের ব্যাপারে সচেতন হওয়া।

বিষয়টা যদি হয়ে থাকে দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে পালানোর চিন্তা, তাহলে এটা মাথায় থাকলে ভালো হবে যে, আল্লাহ আমাদেরকে সবদিক থেকে ঘিরে আছেন। সাময়িকভাবে যতদিন পৃথিবীতে বেঁচে আছি ততদিন পার পেলেও, মৃত্যু হওয়ার সাথে সাথে আমাদেরকে আমাদের প্রতিটা কাজের প্রতিদান পেতে হবে। 

মনের বিশ্বাস অনেক বড় জিনিস। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়। ২০১৫ বিশ্বকাপ শুরুর আগে কেউ যদি বলতেন যে, বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান বিশ্বকাপের মতো আসরে পরপর দু ম্যাচে দুটো সেঞ্চুরি করবেন তাহলে অনেকে হয়তো সেটা হেসেই উড়িয়ে দিতেন। ভারতের বিপক্ষে ওয়ান ডে সিরিজ শুরুর আগে কেউ যদি বলতেন, বিশ্বসেরা ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপকে তছনছ করে দিয়ে তিন ম্যাচে ১৩ উইকেট নেবেন সদ্য টিন-এজ পেরোনো সাতক্ষীরার কোনো তরুণ তাহলে লোকে তাকে অবশ্যই পাগল ভাবতেন। কিন্তু এখন আমাদের মনে বিশ্বাস আছে: নিজেদের দিনে বাংলাদেশ যে কাউকে হারিয়ে দিতে পারে। পারে ব্যক্তিগত সাফল্যের ঝলক দেখিয়ে বিশ্বমঞ্চে নিজের নাম করে নিতে।

ঠিক তেমনি আমাদের মনে এই বিশ্বাস থাকা উচিত যে, একজন আবু বাক্‌র, একজন ‘উমার (তাঁদের উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকুক) নাবি ছিলেন না। কিন্তু নাবির মৃত্যুর পর তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন নাবির অনুসরণে উত্তম নজির। শুধু তাঁরা নন, বিগত ১৪ শ বছর ধরে—এমনকি আজও—অনেক অনেক অনেক মুসলিম পাওয়া যাবে যারা নিরলসভাবে নাবির (সাল্লল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে চলেছেন। আজকে ২০১৬ সালে এসেও মানুষ যে তাঁকে অনুসরণ করতে পারছে, সেটাই প্রমাণ করে, “আপনিও পারবেন”। প্রয়োজন শুধু “ইচ্ছা”, নিজের উপর “বিশ্বাস” এবং নাবির প্রতি “বিশুদ্ধ ভালোবাসা”।

শেয়ার করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *