সৌর বৎসরের হিসেবে আজ আমার মেয়ের এক বছর পূর্ণ হলো। ওর জন্য নির্ধারিত আয়ুষ্কাল থেকে এক বছর কমে গেল। বিষয়টা আশাবাদী (অপটিমিস্টিক) কিংবা নৈরাশ্যবাদী (পেসিমিস্টিক) হওয়ার কিছু না—এটা বাস্তবতা।
প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ আমাদের আয়ুষ্কাল কমে যাচ্ছে একটু একটু করে। আমরা ধেয়ে যাচ্ছি মৃত্যুর পানে। মৃত্যু: সেই অনিবার্য, অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষণ। মৃত্যুর ব্যাপারে আল্লাহর বার্তাবাহক মুহ়াম্মাদ (স়াল্লাল্লাাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
“‘আনন্দকে যা ধ্বংস করে প্রায়ই তাকে মনে করো।’ মানে মৃত্যু।” (সুনান ইব্ন মাজাহ, হাদীস নং ৪৩৯৯। হাদীসটি: হাসান)
কল্পকাহিনির আলাদীনের চেরাগের জিনকে মানুষ যদি কোনো একটি ইচ্ছা জানাতে পারত, তাহলে হয়তো অমর হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করত। কল্পকাহিনি কল্পকাহিনিই। এটা সম্ভব না।
কিন্তু মানুষ কিন্তু এক হিসেবে অমর! পৃথিবীতে একবার মারা যাওয়ার পর তাকে যখন আবার জীবিত করা হবে এরপর কিন্তু আর সে মরবে না। আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ মৃত্যুকে ভেড়ার রূপে এনে জবাই করে প্রতিটি মানুষকে অমরত্ব দেবেন। সেদিন কিছু মানুষের জন্য হবে সবচেয়ে আনন্দের দিন। আর কিছু মানুষের জন্য হবে সবচেয়ে ভয়ংকর দিন।সেদিন জান্নাতবাসীদের জন্য জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। আর কখনো তারা মারা যাবেন না। মৃত্যুভয় ক্ষণিকের জন্যও তাদের তাড়িয়ে বেরাবে না। জান্নাতের চিরস্থায়ী আনন্দ আর বিলাসে মশগুল থাকবেন তারা। মৃত্যুর মৃত্যু তাদের আনন্দ বাড়িয়ে দেবে আরও বহুগুণ।
আর জাহান্নামীরা? ক্রমাগত শাস্তির পেষণের চাইতে মৃত্যুই যাদের চরম আকাঙ্ক্ষিত। অথচ দুনিয়ার জীবনে এর উল্টোটাই কামনা ছিল তাদের। কিন্তু যেদিন মৃত্যুকে জবাই করা হবে, সেদিনের চেয়ে ভয়ংকর, মর্মান্তিক আর কোনো দিন তাদের জন্য আসবে না।আমার মেয়ে এখনো অবুঝ। ভালো-খারাপ, বিপদাপদ, ভয়-শঙ্কা কোনো কিছুরই বুঝ নেই তার। একটা ইলেকট্রিকের সকেট আর নাক-চোখওয়ালা পুতুলের মুখ তার কাছে সমান। সে বুঝে না, কোথায় হাত দিলে তার বিপদ, কোথায় হাত দিলে সে নিরাপদ।
কিন্তু আমরা? আমরা যারা প্রাপ্তবয়স্ক, আমাদের মধ্যে যাদের ভালো-খারাপ, বিপদ-নিরাপদের বুঝ আছে তাদের অনেকেই কি আমার এক বছরের মেয়েটার মতো অবুঝ না? আমরা আমাদের সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে সংশয়ী। যদিও-বা বিশ্বাস করি, তাঁর কাছে নিজেকে সঁপে দিই না। আমরা নিয়মিত তাঁর ঘরে হাজিরা দিই না। তাঁর বিধি মেনে চলি না। অথচ সময় বয়ে যাচ্ছে নদীর স্রোতের মতো। ছোটোবেলায় পড়েছি সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। এই লেখাটা পড়তে পড়তেই আপনার বয়স হয়তো কয়েক মিনিট বেড়ে গেছে। মৃত্যু এগিয়ে এসেছে কয়েক মিনিট। কিন্তু তার জন্য কতটুকু প্রস্তুতি নিয়েছি আমরা?
বর্ষপূর্তিতে আমি আমার মেয়ের জন্য জন্মদিনের কোনো অনুষ্ঠান পালন করিনি। ক্ষুদ্রপরিসরেও না। এই দিনকে উপলক্ষ্য করে কিছুই করিনি; শুধু এই লেখাটা ছাড়া। আল্লাহ চায় তো, আমার মেয়ে যখন বড় হবে, পড়তে শিখবে, বুঝতে শিখবে, ওকে এই লেখাটা পড়াব। আমার বিশ্বাস, আল্লাহ ওকে একজন ধার্মিক নারী হিসেবে গড়ে তুলবেন। সেজন্য আমাদের (আমার ও আমার স্ত্রীর) সম্মিলিত চেষ্টাও থাকবে। আমার চাওয়া আমার মেয়ে ইসলামের এক বিদূষী নারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। দিনে দিনে প্রতিটি পরিবার থেকে যেভাবে ইসলাম থেকেও না-ই হয়ে যাচ্ছে, আমার মেয়ে সেসব ঘরে নতুন করে ইসলামের আলো পৌঁছে দেওয়ার মহান দায়িত্ব পালন করবে। আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত জীবনের প্রেক্ষপটে দীনের বা ইসলামি জীবন ব্যবস্থার দিকে আহ্বান করার জন্য একজন যোগ্য, দক্ষ মুসলিম নারী বড্ড প্রয়োজন। আমার বিশ্বাস আমার মেয়ে সেই দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পন্ন করবে।
আম্মু, তুই অনেক বড় হ। আমি বা আমার মতো যারা মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম, বা এখনো যারা ফুটো নৌকায় জীবন পাড়ি দিচ্ছে তাদের তুই মমতা দিয়ে ডাঙায় নিয়ে আয়। ইসলামের বিপক্ষশক্তি ও ভণ্ডদের কলম ও অস্ত্রের জোরকে উপযুক্ত ও যথার্থ জবাবের মাধ্যমে গুড়িয়ে দে। তোর জন্য অনেক অনেক শুভকামনা, আর দু‘আ। আল্লাহ তোর মঙ্গল করুন। আমীন।