অধ্যাপক রন ফ্রাই তাঁর “ইমপ্রুভ ইউর রিডিং” বইতে কীভাবে বই পড়লে আমরা কোনো বই থেকে সর্বোচ্চ কল্যাণ পাব, সে ব্যাপারে বিভিন্ন টিপ্স, ট্রিক্স ও গাইড শেয়ার করেছেন। তাঁর শেয়ার করা বিভিন্ন গাইডলাইনের মধ্যে একটি ছিল পড়ার উদ্দেশ্য নিয়ে: আমরা কী উদ্দেশ্যে সাধারণত বই পড়ে থাকি। তাঁর মতে সাধারণত নিচের ছয়টি উদ্দেশ্যে আমরা বই পড়ি:
১) কোনো বার্তা আত্মস্থ করা
২) গুরুত্বপূর্ণ কিছু খুঁজে বের করা
৩) কোনো নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর দেওয়া
৪) যা পড়ছি তা মূল্যায়ন করা
৫) যা পড়ছি তা প্রয়োগ করা
৬) বিনোদিত হওয়া
উদ্দেশ্য ছাড়া আপনি যদি কোনো বই পড়েন, তাহলে সেখান থেকে কিছুই আহরণ করার কথা নয়। আপনার উদ্দেশ্যই ঠিক করে দেয় কোনো বই পড়ার ক্ষেত্রে আপনার মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে। সেই বই পড়ে আপনি কী অর্জন করবেন।
একজন মুসলিমের জন্য নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই হওয়ার কথা আল-কুর’আন। কিন্তু আমরা যদি ভালোভাবে খেয়াল করে দেখি, তাহলে দেখব খুব সামান্য কিছু মানুষই উপরের ছয়টির মধ্যে পাঁচটি উদ্দেশ্যে আল-কুর’আন পড়ে থাকেন। বিনোদনের ব্যাপারটা বাদ দিলাম, কারণ কুর’আন কোনো হালকা রসের বই নয়। বিনোদনের জায়গায় আমরা উদ্দেশ্য হিসেবে সাওয়াব লাভের আশা যোগ করতে পারি।
আমার মতে শেষোক্ত উদ্দেশ্যেই উপমহাদেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ আল-কুর’আন পড়ে থাকেন, আর এর ফলাফল আমাদের চোখের সামনেই।
যে-বইটি হওয়ার কথা ছিল মানুষের জীবনে তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্বের বাণী গেঁথে দেওয়ার বই, সেই বইটি থেকে নিয়ে বিভিন্ন সূরাহ্র কথিত নকশা এঁকে তাবিজ বানিয়ে লটকিয়ে শির্ক করা হয়।
যে-বইটি হওয়ার কথা ছিল মানুষের চূড়ান্ত পথনির্দেশ, সেই বইটিই আজ নিক্ষিপ্ত বইয়ের তাকের সবচেয়ে উঁচু তাকে।
যে-বইটি থেকে মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যবহারিক বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার কথা ছিল, তা না হয়ে মানুষ আজ উত্তর খোঁজে ইসলামবিরোধী ও বিদ্বেষীদের অপপ্রচারে ভর্তি দর্শনের বিভিন্ন বইতে।
যে-বইটি মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ হওয়ার কথা, সেই বইটিই আজ সীমাবদ্ধ শুধু নামাজ-রোজার মতো কিছু রীতির মধ্যে।
আমার মতে এর কারণ একটাই: সঠিক উদ্দেশ্য আল-কুর’আন না পড়া। আমাদের স্থানীয় সংস্কৃতির গ্যাঁড়াকলে পড়ে আল-কুর’আন আজ কেবলই সাওয়াব লাভের নিমিত্ত। অনেকে তো সেটাও ছেড়ে দিয়েছেন আজ। দুনিয়ার বুকে জীবন্ত অলৌকিক নিদর্শন আল-কুর’আনের এই বেহাল দশার সঙ্গে মুসলিম উম্মাহ্র করুণ দশা অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।
আমরা যদি আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সাফল্য ও মর্যাদার উঁচু স্তরে উঠতে চাই তাহলে আল-কুর’আনের সঠিক চর্চার কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প থাকবেই বা কী করে! এ যে মানবরচিত কোনো গ্রন্থ নয়: যেখানে ভুল-ত্রুটি, ফাঁক-ফোঁকর থাকেই। এ যে মহান স্রষ্টা আল্লাহর নিজের কালাম। তাঁর নিজের কথা। সেখানে কোনো ভুল নেই, নেই কোনো ফোঁকর। এই বই মানবজাতির পথনির্দেশের চূড়ান্ত এক বই। মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের একমাত্র হাতিয়ার এই বই।
কাজেই আসুন, আল-কুর’আনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাই। সঠিক উদ্দেশ্য নিয়ে একবার বইটি পড়ি। আজকাল বাজারে আল-কুর’আনের কেবল অনুবাদ নিয়ে অনেক বই পাওয়া যায়। যারা পিডিএফ বই পড়তে বেশ সাবলীল তাদের জন্য অনলাইনেও আছে আল-কুর’আনের বিভিন্ন অনুবাদ একেবারে ফ্রি। ইংরেজি, বাংলা দুভাষাতেই যথেষ্ট অনুবাদ এখন হাতের নাগালেই। টাকা বা বিল জমা দেওয়ার সময় যখন দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়, বা দীর্ঘ যানজটে কিংবা দূরের যাত্রায় বসে থাকতে হয়, তখন হাতে তুলে নিন আল-কুর’আনে অনুবাদ। আত্মস্থ করুন এর বার্তা, খুঁজে ফিরুন মনের কোণে দানাবাঁধা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর, প্রয়োগ করুন এর শিক্ষা। হারিয়ে যান কুর’আনে বর্ণিত বিভিন্ন কাহিনির অনুপম বর্ণনায়। সময়কে নষ্ট হতে দেবেন না। আরবি বোঝেন না তো কী হয়েছে। মহান আল্লাহ কী বলেছেন তার নির্যাসটুকু তর্জমার ভাষায় যতটুকু সম্ভব ততটুকুরই স্বাদ নিন। দেখবেন জীবন বদলে যাবে, আদর্শ পাল্টে যাবে। অন্তর নরম হবে। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় এমনিতেই নুয়ে আসবে মাথা। সারা দুনিয়ার গোলামি থেকে মুক্ত হয়ে আপনি হবেন স্বাধীন। প্রকৃত মুক্তমনা।
জীবনের চূড়ান্ত গন্তব্য জান্নাতের অভিযাত্রায় এর যে আসলেই কোনো বিকল্প নেই।