প্রসব-পরবর্তী চিকিৎসা হিসেবে অন্যান্য বেশ কিছু ওষুধের সঙ্গে ডাক্তার আমার স্ত্রীকে দুটো এন্টিবায়োটিক ওষুধ দিয়েছেন। একটা আট ঘণ্টা পরপর, আরেকটা ছয় ঘণ্টা পরপর খেতে হচ্ছে। আমরা ঠিক নিয়ম করেই ওষুধগুলো তাকে খাওয়াচ্ছি। এন্টিবায়োটিক ওষুধগুলো একটা
নির্দিষ্ট সময় পরপর না-খাওয়ালে কিছু সমস্যা হয়। একারণে আমরা এব্যাপারে বেশ সতর্ক। যেহেতু ব্যাপারটা চিকিৎসা-সংক্রান্ত সেহেতু ডাক্তারের নির্দেশই এব্যাপারে শিরোধার্য। কারণ, অসুখ-বিসুখ রোগব্যাধির ব্যাপারে তারাই সবচেয়ে ভালো জানবেন। তাই কোনো ধরনের তর্ক-বিতর্ক, প্রশ্ন না করেই আমরা বিনা দ্বিধায় চিকিৎসা-সংক্রান্ত ব্যাপারে ডাক্তারের আদেশ বাধ্য সন্তানের মতো পালন করে যাই।
মজার ব্যাপার হচ্ছে শারীরিক অসুখের ব্যাপারে মানুষ যতটা নিয়মানুবর্তী, আধ্যাত্মিক ব্যাপারে তারা ঠিক ততটাই উদাসীন। মানুষের মনেরও যে চিকিৎসা প্রয়োজন, ওষুধ প্রয়োজন এবং যেক্ষেত্রে অবজ্ঞা পরকালীন অনন্ত জীবনে মানুষকে জাহান্নামের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে সে ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষই বেখেয়াল।
আধ্যাত্মিক চিকিৎসার জন্য প্রথম ওষুধ হচ্ছে আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস। তাঁর রাসূলের পরিপূর্ণ অনুসরণ। তাঁর নির্দেশকৃত অত্যাবশ্যকীয় ফার্দ় (ফরজ) ‘ইবাদাতগুলোর যথাযথ পালন। এসব ‘ইবাদাতের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে প্রতিদিন পাঁচ বার স়ালাত আদায়। দৈনন্দিন জীবনে সংসার ও কাজের ব্যস্ততায় আমাদের হৃদয় ও মন যখন দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে যায়, আল্লাহ স্মরণ থেকে দূরে সরে যায় তখন স়ালাত আমাদেরকে সেই চিরসত্যের কথা মনে করিয়ে দেয়: স়ালাতে যেভাবে আমরা আল্লাহর সামনে বিনম্রভাবে দাঁড়িয়েছি, বিচারদিনে ঠিক এভাবেই আমাদেরকে দাঁড়াতে হবে তাঁর সামনে।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে অনেকে হয়তো স়ালাতে দাঁড়ান ঠিকই, কিন্তু সেটা স্রেফ দাঁড়ানোর জন্য দাঁড়ানো। আরও করুণ পরিস্থিতি হচ্ছে অধিকাংশ মানুষ স়ালাতই আদায় করেন না। করলেও অনিয়মিত।
ডাক্তারের দেওয়া নির্দেশপত্র মেনে মানুষ ঠিকঠাক সময়মতো ওষুধ সেবন করলেও, আল্লাহর নির্দেশ মানতে সেই মানুষই চরম অবহেলার পরিচয় দেন। কেন? তাহলে কি আল্লাহর উপর মানুষের পরিপূর্ণ বিশ্বাস নেই? আল্লাহর দেওয়া বিধিকে তারা কল্যাণকর মনে করে না? মানুষ যদি সত্যিই আল্লাহকে বিশ্বাস করে, তাঁকে ভালোবাসার দাবি করে, সব বিষয়ে তাকেই সবচেয়ে জ্ঞানী বলে মানে, তাহলে তাঁর দেওয়া বিধান মানতে কীসের এত অনীহা?
ইসলাম কোনো আচারসর্বস্ব ধর্ম নয়। এটি একটি জীবন ব্যবস্থা—কমপ্লিট কোড অফ লাইফ। স়ালাত, আল্লাহর স্মরণ, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং সেজন্য আল্লাহ যেগুলো করতে নিষেধ করেছেন সেগুলো থেকে বিরত থাকা—মুসলিম হিসেবে গর্বিত হওয়ার উপকরণ এগুলোই। মুসলিম মানে এই না যে মানুষের খুব সুন্দর একটা আরবি নাম হবে। অনেক নাবিই আরব দেশে জন্মগ্রহণ করেননি এবং তাদের নাম আরবিও ছিল না। তবু তারা ছিলেন মুসলিম—আল্লাহর কাছে সমর্পণকারী।
ডাক্তারের ঘরে জন্মালেই কোনো শিশু ডাক্তার হয়ে যায় না। সুদীর্ঘ পঁচিশ-ত্রিশ বছরের নিরলস অধ্যয়নের ফলেই একজন মানুষ ডাক্তার হয়ে উঠেন। তেমনি মুসলমানের ঘরে জন্মেছে বলেই কেউ মুসলিম হয়ে যায় না। এই উপাধি অর্জন করতে হয়। নিজের মধ্যে আদর্শ মুসলিমের গুণাবলি গড়ে তুলতে হয়। আর সেজন্য প্রয়োজন আল্লাহর দেওয়া প্রেসক্রিপশনের যথাযথ অনুসরণ।
এটা মানুষের পরম সৌভাগ্য যে, আল্লাহ শুধু প্রেসক্রিপশন (আল-কুর’আন ও আস-সুন্নাহ) দিয়েই কাজ শেষ করেননি, তিনি এই প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়ন ও ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য একজন নাবিকেও পাঠিয়েছিলেন; ফেরেশতা কিংবা ভিনগ্রহের কোনো প্রাণী নয়—মাটির তৈরি জ্বলজ্যান্ত এক মানুষ: মুহ়াম্মাদ বিন ‘আবদুল্লাহ (স়াল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। নাবি মুহ়াম্মাদ সুদীর্ঘ তেইশ বছর ধরে দেখিয়ে গিয়েছেন কীভাবে আল্লাহর সেই প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়ন করতে হয়। প্রয়োগ করতে হয়।
কেবল আল্লাহকে বিশ্বাসই যথেষ্ট নয়। যদি তা-ই হতো তাহলে শয়তানও বিচারদিনে পার পেয়ে যেত। কেননা সে কিন্তু ঠিকই আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী। কিন্তু আল্লাহর একটি আদেশ অমান্য করার কারণে অনন্তকাল ধরে সে অভিশপ্ত। মানুষ নিজেরাই “শাইত়ানির-রাজীম” (অভিশপ্ত শয়তান) বলে প্রতিনিয়ত তাকে অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে। অথচ সেই একই মানুষ শুধু চব্বিশ ঘণ্টায় কতবার যে আল্লাহর কত ফরজ আদেশ তরক করে চলেছে তার হিসেব নেই। অন্যান্য নির্দেশের কথা না-হয় তোলাই থাকল।
তবু এতকিছুর পরও সব শেষ হয়ে যায়নি। নিভু নিভু হলেও ঈমানের সলতেটা এখনো জ্বলছে। তাকে পরিপূর্ণভাবে প্রজ্জ্বলিত করার দায় মানুষেরই। আর সেজন্য প্রয়োজন শুধু আল্লাহর দেওয়া প্রেসক্রিপশনের যথাযথ অনুসরণ। এভাবেই আসবে দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তি। এভাবেই আসবে চিরমুক্তি।